সুধীর বরণ মাঝিঃ–
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবদ্যিালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।
দেশটা যেন এক শিশুপার্ক, ইচ্ছের দোলনায় দোলে সবাই। জীবন সংস্কৃতি আজ অপসংস্কৃতির অবাধ চর্চাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে আজ নারকীয় পরিবেশ। কি ঘরে কি বাইরে সর্বত নারকীয় অবস্থা।
পত্রিকার পাতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা টেলেভিশন খুললেই দেখি এবং শুনি হত্যা, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন,গুম, অপহরণ, আত্মহত্যা, মাদক, টাকা পাচার, মানব পাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, আত্মসাৎ, অবৈধ দখল, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের কারসাজিতে বাজার মূল্যের অস্থির অবস্থা প্রভৃতি নেতিবাচক খবর। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট, ঘন ঘন লোডশেডিং, সড়কে ভয়াবহ জানজট ও মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে জনজীবন। যেন দেখার কেউ নেই। নেতিবাচক খবরের স্রোতে ইতিবাচক খবর হারিয়ে যেতে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সর্বতই দেখি খাই খাই আমার আমার আত্মকেন্দ্রিকতার সর্বোচ্চ চর্চা। এমন কোন সংবাদ দেখিনা যেটা নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে পারি। এইভাবে চলতে থাকলে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন সোনার বাংলা একদিন হারিয়ে যাবে গভীর অন্ধকারে।
যাদের বিবেকের তাড়নায় দেশ এগিয়ে যাবার কথা, সমৃদ্ধির পথে হাঁটার কথা ব্যক্তি স্বার্থে তাদের বিবেকের চেতনায় আজ মরিচা ধরেছে। বাংলাদেশের জনগণ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার পরও আমাদের জাতীয় রাজনীতি আজও নূন্যতম জাতীয় ঐক্য বা জনগণের ঐক্য স্থাপনে ব্যর্থ। নানা ধরনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো নানামুখী উস্কানিমূলক কথা বলে পরিস্থিতিকে প্রতিনিয়ত আরো জটিল ও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। নূন্যতম পারস্পারিক সহিষ্ণুতার মনোভাব নেই। সবর্ত্র চরম অসহিষ্ণুতা বিরাজমান। পরস্পরকে চিরকালের জন্য শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত, বিধ্বংসী যুদ্ধ চলমান। ব্যক্তি স্বার্থের চরম
মানসিকতায় মানবিকমূল্যবোধের চরম বিপর্যয় অহরহ। সর্বক্ষেত্রে চলমান এ বিরোধিতা ও বিপর্যয় সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদী অপশক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বিচারপ্রবণ মন দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা ধারায় বিভক্ত যা জনগণের মধ্যে বিভক্তি বাড়িয়েই চলছে। বাংলাদেশে ইংরেজি মিডিয়াম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা দ্রুত প্রসার ঘটছে। আমলা, সেনা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক,সাংবাদিক তথা দেশের এলিট শ্রেণির সিংহভাগ ইংরেজি মিডিয়াম এবং মাদ্রাসা শিক্ষার ধারায় সমপৃক্ত হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ইংরেজি ভক্তরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সবকিছুর উপর নিজেদের নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বসে আছে।
অন্যদিকে মাদ্রাসা ভক্তরাও তাদের আধিপত্য বিস্তারের নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এ ধারার পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশ নেই বললেই চলে। এ ধারার অনুসারীরা বিশ্বায়ন নিয়ে যতটা উৎসাহী ঠিক ততটাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদাসীন। এর মধ্য দিয়ে দেশের সম্পদ ধ্বংষ করে তৈরি হচ্ছে দেশপ্রম বর্জিত এক শ্রেণির যুব ও তরুণ সমাজ।
বিকাশমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই পথে চলার চেষ্টা করছে। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে না তুলে জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে ফেলার শিক্ষা আত্মঘাতী। চলছে হযবরল শিক্ষা। যে যা পারছে বলছে। সত্য মিথ্যার কোন বালাই নাই।
শিক্ষা হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র চাকরিপাওয়ার এবং সাধারণ মানুষকে শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে। আমাদের দেশের শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ এতাটা আপোসকামী হয় কিভাবে? একদল মানুষ সাধারণ মানুষকে অন্ধ বানিয়ে রাখার জন্য সত্যের ওপর মুখরোচক আফিমী প্রলেব লাগিয়ে প্রচার করছে। আত্মমর্যাদাহীন পদলেহনকারী এই মানুষগুলো নিজ স্বার্থস্বিদ্ধীর জন্য যা খুশি তা বলে যাচ্ছে, যা খুশি তা করে যাচ্ছে, সৃষ্টি করছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নষ্ট করছে সম্প্রীতি। আর এই কাজের বিরোধীতা করলে নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন।একদল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আরেক দল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের যেমন খুশি নাচাচ্ছে।
দায়িত্বশীলরা যে যার মতো করে যা খুশি তা বলে যাচ্ছে। চরম অবহেলার শিকার দেশমাতৃকার সাধারণ মানুষ। আমরা তাই দেখি জলের অভাবে কৃষকের আত্মহত্যা, মেসের টাকা জোগার করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ব্যাগের টাকা না পেয়ে স্কুল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। আমরা দেখি সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে পিতার আত্মহত্যা। বিনা চিকিৎসায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু।
ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নিরাপত্তার অভাব, বেকার সমস্যা, সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির অবাধ প্রসার জনমনে হতাশার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাগুলো আজ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তুু আমরা নিশ্চুপ। এগুলো ভাবিয়ে তুলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।একদিকে দিনে দিনে বাড়ছে খেলাপী ঋণের পরিমান, কালো টাকা, দখলদারিত্ব ও অপরাধীর সংখ্যা, আধিপত্যকে কেন্দ্র করে বাড়ছে বিরোধ অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে এবং সেই সাথে দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। আপন হয়নি সমাজের সুউচ্চ আসনে থাকা মানুষগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের।
সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আজ নাগালের বাইরে। ব্যবসায়ীরা আজ অবৈধভাবে টাকার মালিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিশু খাদ্য থেকে গো খাদ্য কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্য নেই। ভেজালের ভীড়ে চারদিকে একাকার। বৃদ্ধি পেয়েছে নারী ও শিশু ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু বলাৎক দেশে সাংস্কৃতিক সংকট আজ চরম আকার ধারণ করেছে।
শিক্ষা তার লক্ষ্যকে হারিয়ে বহিরাবরণের দিকে ছুটছে। স্বাধীন দেশে পরাজিত শক্তির ভয়ে এখনো ভীত আমরা। তাইতো দেখে জাতীয় উৎসবগুলোতে প্রাণের আনন্দ মিলে না নিরাপত্তার ভয়ে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন বেপরোয়া হচ্ছে কিশোর গ্যাং। উঠতি তরুণ ও যুবসমাজ সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার পরিবর্তে টিকটকের মতো অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যেন দেখার কেউ নেই। নেই আইনের সঠিক প্রয়োগ, নেই স্বচ্ছতা, নেই জবাবদিহিতা। ঘুষ ছাড়া সরকারি অফিসে কোন সেবা মিলেনা। প্রকল্পের নামে চলছে হরিলুট। আমরা শংকিত, আমরা ভীত আমদের নিরাপত্তা, সন্তানদের নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে। আমরা শংকিত, আমরা ভীত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির নিরাপত্তা নিয়ে। এই নিরপত্তা সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক নিরাপত্তা এবং শিক্ষার নিরাপত্তা।সব মিলে মনে হচ্ছে অভিভাবকহীন সমাজে বাস করছি।
দেশের সমৃদ্ধি উন্নয়নকে গতিশীল এবং ত্বরান্বিত করতে আইনের সঠিক প্রয়োগ, স্বচ্ছতা এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করতে হবে। শিক্ষার বৈষম্য দূর করে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার, সেইসাথে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে আধুনিক লাইব্রেরি, বিজ্ঞান ক্লাব এবং একটি করে খেলার মাঠ নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতিকে মাদকের ভয়াল থাবা, অনৈতিক, অমানবিক মূল্যবোধের চর্চা থেকে তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করে দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে রাজনীতিবিদদের হাতে। দেশপ্রেম বর্জিত, মানবিক মূল্যবোধহীন শিক্ষার পরিবর্তে নৈতিক, মানবিক এবং দেশপ্রেম সমৃদ্ধ শিক্ষার ব্যাপক আয়োজন এবং প্রসার ঘটাতে হবে। সেই সাথে উচ্চ শিক্ষাকে সকলের জন্য মুক্ত করে দিতে হবে। বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রয়োগ করতে হবে। কালোটাকা, ঋণখেলাপী টাকা এবং বিদেশে পাচার হওয়া টাকা সততার সাথে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের স্বার্থে সাংবিধানিক প্রয়োগ নিশ্চিত
করতে না পারলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং বৈষম্য আরো চরম আকার ধারণ করবে। দেশের স্বার্থ, সমৃদ্ধিকে ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। দেশটা যেনো শিশুপার্ক না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সম্প্রীতির বাংলাদেশ, শিক্ষা – সংস্কৃতি- উৎসবের নিরাপদ বাংলাদেশ, নৈতিক – মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সেই প্রত্যাশা ও মানসিকতা হউক আমোদের সকলের।
জাতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরকে ইতিবাচক এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।