১ জুন বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৯ সালের ৩১ মে শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ সালে বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামের বিখ্যাত মিয়া পরিবারে জন্ম মানিক মিয়ার মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।
সাংবাদিক হিসেবে মানিক মিয়া যেভাবে দেশের কথা, দেশের জনগণের কথা বলতে গিয়ে কারা নির্যাতন ভোগসহ বিভিন্নমুখী হয়রানি -নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এ রকম আর কোনো সাংবাদিক হননি। তিন বার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সামরিক আইনে তার বিচার হয়েছে, ১৯৬৬ সালে শেষবার গ্রেফতার হওয়ার পর একাধারে দুই বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব-মোনায়েম চক্র মানিক মিয়ার ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার অন্য দুটি পত্রিকা সাপ্তাহিক পূর্বাণী ও ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমসের প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয়। এখানেই শেষ নয়, ইত্তেফাক ও অন্য দুটি সাময়িকী যে ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতো, সেই ছাপাখানাও বাজেয়াপ্ত করে। প্রায় আড়াই বছর বন্ধ থাকে। দুই বছর জেলে থাকা অবস্থায় কিছু শর্তে কারামুক্তি এবং পত্রিকা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে আপসহীন সাহসের বরপুত্র মানিক মিয়া কারাজীবন, কষ্ট ও নির্যাতনকেই বেছে নিয়েছেন।
১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পর ১৯৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে মানিক মিয়াকে প্রথম বারের মতো গ্রেফতার করা হয়। সামরিক আইনে তিনি অভিযুক্ত হন। অতঃপর সামারি মিলিটারি কোর্টে তার বিচার এবং পরে মুক্তি দেওয়া হয়। আইয়ুব খান সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের পর সামরিক শাসনের মধ্যে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন শুরু হয়। শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে মানিক মিয়াও গ্রেফতার হন। জননিরাপত্তা আইনে দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হওয়ার প্রায় সাত মাস পর ১৪ আগস্ট তিনি মুক্তি লাভ করেন। মানিক মিয়া তৃতীয় বারে গ্রেফতার হন ১৯৬৬ সালে। ঐ বছরের (১৯৬৬) ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলীয় সম্মেলনে শেখ মুজিব ৬ দফা দাবি পেশ করেন। সম্মেলনে আলোচ্যসূচি হিসেবে ৬ দফা গৃহীত না হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ঐ সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে শেখ মুজিব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবি দেওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও তার বশংবদ গভর্নর মোনায়েম খান ৬ দফার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন। শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নয়, পূর্ব পাকিস্তানের কোনো দল বা নেতা ৬ দফা সমর্থন করেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ আরো অনেকে ৬ দফার বিরোধিতা করেন। তখন সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনেকে কথা পর্যন্ত বলতে সাহস করতেন না। এমনকি মওলানা ভাসানী পর্যন্ত ৬ দফার বিরোধিতা শুরু করেন। এ সময় মানিক মিয়া ৬ দফার সমর্থনে জোরালো ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন। পরিস্থিতি ঘুরে যায়।
ঐ সময় আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও ৬ দফার সমর্থনে মানিক মিয়া ও তার ইত্তেফাক ছাড়া আর কেউ ছিল না। ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে মানিক মিয়া কলাম লিখতেন। সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতনের মুখে ৭ জুনের হরতাল যে সফলভাবে পালিত হলো, এর খবরও ইত্তেফাক ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। সরকারি হিসাবেই হরতালে ছয় জন নিহত হন। আসলে হরতালে মনু মিয়া, মুজিবুরসহ ১১ জন নিহত ও বহু লোক আহত হন।
জীবনের শুরু থেকেই মানিক মিয়া প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। অন্যায়, অনিয়ম, জুলুম নিজে যেমন করতেন না, আর যারা করতেন, তাদেরও ছাড় দিতেন না। বিএম কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশের পর পিরোজপুর কোর্টে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ঐ সময় কোর্টের একজন মুনসেফ মানিক মিয়ার প্রতি অন্যায় আচরণ করলে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। মুনসেফ পরে মানিক মিয়ার পিতৃব্য এবং তৎকালীন একজন মশহুর আইনজীবী আফতাব আহমদের শরণাপন্ন হন এবং তার সহযোগিতায় তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। মুনসেফ কোর্টে থাকা অবস্থায়ই তিনি ঘটনাক্রমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচিত হন। সোহরাওয়ার্দীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কোর্টের চাকরি ছেড়ে মানিক মিয়া তৎকালীন বাংলা সরকারের জেলা জনসংযোগ অফিসারের চাকরিতে যোগদান করেন। ঐ সময়কালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের শক্তিশালী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পান তিনি। প্রখর যোগ্যতাসম্পন্ন দূরদর্শী নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনন্য গুণাবলিসম্পন্ন মানিক মিয়াকে তৎকালীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন।
নীতি -আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন মানিক মিয়া দীর্ঘকাল কারা নির্যাতন ভোগের পর ১৯৬৭ সালের ২৯ মার্চ ঢাকাস্থ পুলিশ হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর পত্রিকা ও প্রেস ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখানো হয়। আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক মানিক মিয়ার কাছে দেশ ও জনগণের স্বার্থই ছিল সবচেয়ে বড়। দেশপ্রেমিক, সৎ, সজ্জন, স্পষ্টভাষী, আত্মত্যাগী, অসম সাহসী মানিক মিয়ার জীবনের অসাধারণ কর্মকাণ্ডের কথা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু ৯ বছরের বড় -ছোট। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন, ‘আমরা দুজন দুই ফ্রন্ট থেকে কাজ করেছি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে মানিক ভাই এর অবদানের কাহিনী অনেকেরই অজানা। পক্ষান্তরে আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাই’র প্রভাব যে কত গভীর তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়।’
আর এ জন্যই কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক নিরঞ্জন হালদার ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় (১৩৭৯) লিখেছেন, ‘মানিক ভাইয়ের আবির্ভাব না ঘটলে বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাবও সম্ভব হতো না।’
বাংলাদেশের যত বিশেষণ আছে, এর প্রায় সবগুলোই মানিক মিয়ার নামের পাশে লেখা যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য এই দেশ ও জাতি মানিক মিয়ার কাছে বিশেষভাবে ঋণী। অমর মানিক মিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।