মুসলিমদের সবচেয়ে বড় দুই ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। বিশ্বজুড়ে ঈদের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্য একই রকম হলেও প্রতিটি দেশ ও সংস্কৃতির নিজস্ব অনন্য রীতিনীতি ও চর্চা রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করা, নতুন জামাকাপড় কেনা বা আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করা যাই হোক না কেন- ঈদ হলো আনন্দ, ক্ষমা এবং উদযাপনের সময়। চলুন জেনে নেই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে কীভাবে ঈদ উদযাপন করা হয়:
বাংলাদেশে ঈদ
বাংলাদেশে ঈদ মানেই জাঁকজমক উৎসবের আমেজ। কয়েক দিন আগে থেকেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেন সবাই। ঘরে ফেরা এবং পরিবার পরিজনসহ সবার সঙ্গে দেখা করার একটা উপলক্ষও ঈদ। নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাওয়া, নামাজ শেষে সবার সঙ্গে ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি করা হয়। বেশিরভাগ মেয়েরা আগের রাতে হাত রাঙায় মেহেদির রঙে।
বাংলাদেশে ঈদের দিনে বাড়িতে বাড়িতে রান্না হয় মজাদার নানা খাবার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- সেমাই, পায়েস, মাংস, কোর্মা-পোলাও, খিচুড়ি, রোস্ট ও বিরিয়ানিসহ বাহারি সব খাবার। বিভিন্ন এলাকায় শিশু-কিশোরদের জন্য ছোট ছোট মেলা আয়োজন করা হয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করার প্রচলন রয়েছে। এ দিনটিতে বয়স্করা ছোটদের ‘ঈদ সালামি’ দিয়ে থাকেন।
সৌদি আরবে ঈদ
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সৌদিরা বিভিন্ন উৎসবমুখর অনুষ্ঠান এবং বিনোদনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। দিনটি উদযাপনের অংশ হিসাবে দেশটি জাঁকজমক সাজে সাজানো হয়। পরিবার এবং বন্ধুরা সাধারণত ঈদের বিশেষ খাবারের জন্য একত্রিত হয়। সকালে খাবার পরিবেশন করার আগে পরিবারের বাচ্চারা বয়স্কদের থেকে ‘সালামি’ নেয়।
সৌদি আরবে ঈদে একটি অনন্য ঐতিহ্য হলো- স্থানীয়রা কম তুলনামূলক গরীব কিংবা সবার বাসার দরজায় প্রচুর পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ও খাবার রেখে যান। সৌদিতে ঈদের স্পেশাল খাবারের মধ্যে রয়েছে মুগলগাল, জেরিশ এবং ঘুরাইবাহ। মুগলগাল সৌদি আরবের অন্যতম বিখ্যাত খাবার। ঈদের সময় সাধারণত উপভোগ করা এই খাবারে মশলার সাথে ভাজা ভেড়ার মাংস, তাজা টমেটো, পেঁয়াজ এবং সবুজ মরিচ থাকে। দেশটিতে ঈদুল ফিতর ‘মিষ্টি ঈদ’ হিসাবেও পরিচিত। দিনটিতে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি খাবার খাওয়া হয়।
ভারত-পাকিস্তানে ঈদ
ভারত-পাকিস্তানে ঈদ উদযাপনের রীতি অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। ভারতে ঈদের দিন স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সরকারি অফিস আদালত এমনকি কিছু কিছু দোকান ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ঈদগাহ ও বড় বড় জামে মসজিদগুলোতে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। বড়দের সালাম দিয়ে ছোটরা পেয়ে থাকে ঈদের সালামি। খাবারের মধ্যে রয়েছে মাংস, পোলাও, রুটি, পরোটা।
পাকিস্তানে ঈদের দিন সকালে পরিবারের সবাই এক হয়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবার, ঐতিহ্যবাহী শির-কোরমা দিয়ে নাশতা করে। অনেকে পার্ক, মনোরম স্থান ও সাগর তীরে ঘুরতে যায়।
তুরস্কে ঈদ
তুরস্কে ঈদুল ফিতর ‘সেকের বায়রাম’ নামেও পরিচিত, যার অর্থ ‘চিনির উৎসব’। দেশটিতে জাতীয়ভাবে উদযাপিত সমস্ত উত্সবকে ‘বায়রাম’ হিসাবে উল্লেখ করার ঐতিহ্য রয়েছে। ঈদ-বায়রামের আনন্দ দেশব্যাপী ঐতিহ্যের সাথে মিশে যায়। তুর্কিরা সাধারণত একে অপরকে ‘বায়রামিনিজ মুবারেক ওলসুন’ বা ‘বায়রামিনিজ কুতলু ওলসুন’ দিয়ে সম্বোধন করে।
প্রার্থনা এবং পারিবারিক সমাবেশ ঘটে দিনটিতে। সবাই মিলে বিশেষ করে শিশুরা দেশটির বিভিন্ন ঐতিহ্যগত আনন্দে মাতে। দিনের একটা অংশে আনন্দ-উদযাপন শেষে তুর্কিরা তাদের কাছের এবং প্রিয়জনদের সাথে দেখা করেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মূলত সবাই সবার প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আনন্দের মধ্য দিয়ে দিনটি পার করে।
আরব আমিরাতে ঈদ
আমিরাতে ঈদ মানেই ‘ওউজি’ নামক একটি বিখ্যাত স্থানীয় খাবার। উৎসবের জন্য একচেটিয়াভাবে দেশজুড়ে এটি প্রস্তুত করা হয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে রান্না করা খাবারটির মধ্যে রসালো ছাগলের মাংস ও ভাতের মিশ্রণ থাকে। এর সঙ্গে ভাজা পাইন বাদাম দেওয়া হয়। দিনটিতে আমিরাতিরা বাহারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এতে ম্যাজিক ট্রিকস খুব জনপ্রিয়।
মালয়েশিয়ায় ঈদ
মালয়েশিয়ানরা ঈদের আগের দিন তাদের নিজ নিজ শহরে ভ্রমণে বের হয়। উত্সবের আগের দিনটি তাদের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত সময় থাকে। তারা পেলিটা’ (তেলের প্রদীপ) দিয়ে ঘর সাজায় এবং ঐতিহ্যবাহী নানা খাবার প্রস্তুত করে। কেতুপাট, কুইহ রায়া, লেমাং, রেন্ডিং ইত্যাদি দেশোটিতে ঈদের দিনের জনপ্রিয় খাবার। সবাই মিলেমিশে খাওয়াদাওয়া ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মালয়েশিয়ার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হলো ‘উন্মুক্ত ঘর’। যেখানে খাবারের পাশাপাশি সবাই মিলে আনন্দ-আয়োজনের সঙ্গে ভালো সময় উপভোগ করার জন্য একত্রিত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ
ইন্দোনেশিয়ায় ‘লেবারান’ নামে পরিচিত একটি বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। লোকেরা ‘ল্যাপিস লেজিট’ নামে একটি ঐতিহ্যবাহী হাজার স্তরের কেক বেক তৈরি করে। লেবারান উৎসবের আগে প্রচুর মানুষ ড্রাম বাজায় ও আতশবাজি জ্বালায়। শপিং মলগুলো শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার জন্য লোকারণ্য হয়ে যায়।
মিশরে ঈদ
মিশরীয়রা ঈদ-উল-ফিতরের দিনটি পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে ভোজ এবং সময় কাটানোর মাধ্যমে পার করে। দিনটিতে সবাই ‘ফাত্তার’ নামক বিশেষ খাবার প্রস্তুত করে। এটি ভাত, মাংস ও রুটির মিশ্রণ এবং কুনাফা, পনির দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টান্ন। মিশরীয়দেরও তাদের সন্তানদের জন্য নতুন জামাকাপড় এবং নানা আয়োজনের ঐতিহ্য রয়েছে।
নিউজিল্যান্ডে ঈদ
নিউজিল্যান্ডে মসজিদ বা বাহিরের খোলা স্থানে নামাজের মধ্য দিয়ে ঈদ উদযাপন শুরু হয়। তারপর মুসলিমরা সমেবেত হন ও বিভিন্ন পরিবার উপহার বিনিময় করে। একসাথে ঐতিহ্যবাহী খাবারও খাওয়া হয়। সম্প্রতি অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন এবং ক্রাইস্টচার্চের মতো বড় শহরগুলোতে ঈদ উত্সব আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, খাবারের স্টল এবং শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। দেশটির অকল্যান্ডে বাড়িঘর পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে দিন শুরু হয়। তারপর ইডেন পার্কে যান্ত্রিক ষাঁড়, হিউম্যান ফুসবল এবং বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে খাবার বিক্রি করা হয়। এই উদযাপন মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বৃহত্তর নিউজিল্যান্ড সম্প্রদায়ের মিশ্রণকে প্রতিফলিত করে, দেশের বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি প্রদর্শন করে।
আইসল্যান্ডে ঈদ
আইসল্যান্ডে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, তবে সম্প্রদায়টি বাড়ছে। দেশটির রেকজাভিকের কয়েকটি মসজিদের মধ্যে একটিতে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের নামাজ। যেখানে অতিথিরা বিভিন্ন রান্না করা খাবার নিয়ে আসেন এবং সবাই মিলে তা উপভোগ করেন। আইসল্যান্ডের গ্রীষ্মের দিনগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ, তাই সেখানে মানুষ ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা রাখে। যদিও দেশটিতে ইসলামি বিশেষজ্ঞরা নিকটতম দেশ থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় বা সৌদি আরবের টাইমজোন পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে রোজা ভাঙার পরামর্শ দিয়েছেন। শিশুরা তাদের সুন্দর পোশাক পরিধান করে এবং ঈদুল ফিতরের আনন্দ-উপহার বিনিময় করে।
যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল ফিতর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করে। দেশটিতে মসজিদ বা উন্মুক্ত স্থানে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। তারপর পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে নানা আয়োজন ও সুন্দর সময় উদযাপন করে। আমেরিকান মুসলিমরা তুলনামূলক গরিবদের সাহায্য করার জন্য কমিউনিটি সার্ভিস প্রকল্পে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে ঈদের সংস্কৃতির মধ্যে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা, ঐতিহ্যবাহী সংগীত শোনা এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার উপভোগ করা উল্লেখযোগ্য।