প্রায় ১০০ বছর আগে নারীদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে লড়াই করে গেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) স্নাতক রেনু ফাতেমা, বর্ষা রানী, সুইটি সরকারদের সঙ্গে দেখা হলে আজ তিনিই বোধ হয় সবচেয়ে খুশি হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স মাত্র ১৩ বছর। এরই মধ্যে প্রাক্তন ছাত্রীদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, কেউ সরকারি দপ্তরে কাজ করছেন, কেউবা গবেষণায় যুক্ত আছেন দেশের বাইরে। সুনামের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন বেরোবির প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।
রংপুর অঞ্চলে তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বইমেলা, সবই জমে ক্যাম্পাস ঘিরে। তা ছাড়া সবুজে ঘেরা পরিবেশে বুকভরে দম নিতে হাজির হয়ে যান অনেক দর্শনার্থীও।
৮ ও ৯ জুন ক্যাম্পাস ঘুরে কথা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শুনলাম তাঁদের স্বপ্ন, ভালো লাগা, পাওয়া না পাওয়ার কথা।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর এটি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে। শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন হয় ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল। পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম ক্যাম্পাস ছিল রংপুর শহরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে। সে সময় ছয়টি বিভাগে মাত্র ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় পাঠদান। এরপর ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি নগরের পার্ক মোড়ের পাশে ৭৫ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে বর্তমান ক্যাম্পাস।
এখন ৬টি অনুষদে, ২২টি বিভাগের প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। শিক্ষক আছেন ১৮৬ জন। ক্যাম্পাসে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন ছাড়াও ছাত্রীদের থাকার জন্য আছে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল আর ছেলেদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ মুখতার ইলাহী নামে দুটি হল। ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা নামে আরও একটি হলের নির্মাণকাজ চলছে।
কদিন আগেও শিক্ষার্থীদের অন্যতম বড় অভিযোগ ছিল সেশনজট। করোনাকালে এই জট আরও প্রকট হয়। এখন ধীরে ধীরে সমস্যা কাটিয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী অপূর্বকৃষ্ণ রায় বলছিলেন, ‘যেভাবে সেশনজটে পড়েছিলাম, ভয় হচ্ছিল অনেক পিছিয়ে যাব। কিন্তু এক বছরের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষাগুলো হয়ে গেল। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিক সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা। প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রথমেই চোখে পড়বে খোলা মাঠ। পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। গাছগাছালির ছায়ায় চারটি একাডেমিক ভবন আর প্রশাসনিক ভবনও ঢাকা পড়েছে।
স্বাধীনতা স্মারক থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, গাছগুলোর নিচে ছোট ছোট দলে বসে আছে শিক্ষার্থীরা। অনেকের আবার কাঁধে ব্যাগ কিংবা খাতা হাতে ছুটছিলেন একাডেমিক ভবনের দিকে।
প্রায় ৩০০ প্রজাতির ছোট-বড় গাছ আছে এই ক্যাম্পাসে। আলাদা করে ৩৬ হাজার গাছ লাগানোর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুর জামানের সঙ্গে কথা হলো। ভালো বিতার্কিক হিসেবে ক্যাম্পাসে তাঁর পরিচিতি আছে। বলছিলেন, ‘এখনো অনেক দিন ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কৃতি চর্চা করতে চাই। পড়া শেষ করে চলে গেলেও যেন ক্যাম্পাসের স্মৃতিতে নাম জড়িয়ে থাকে, এমন কিছু ভালো কাজ করে যেতে চাই।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রওনক জাহান বলেন, ‘সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাস আমাদের বারবার টানে। ক্লাস শেষের ক্লান্তি নিয়ে বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি করলে মন ভালো হয়ে যায়। ক্যাম্পাস আমাদের অনেক দিয়েছে। কিছুটা হলেও তো ঋণ শোধ করতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কিছু করার চেষ্টা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কোনো মিলনায়তন নেই। স্বাধীনতা স্মারকে উন্মুক্তভাবে নানা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ক্যাম্পাসের ক্লাবগুলো সারা বছর মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করে এই প্রাঙ্গণ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক আয়োজন থেকে শুরু করে বিতর্ক, রক্তদান, বইমেলা আয়োজনের মতো নানা কিছুতে নেতৃত্ব দেয় এসব ক্লাব। বিতর্ক নিয়ে কর্মশালা হয় নিয়মিত।
নিয়মিত রক্তদান করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বাঁধন’। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, প্রাণের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে একদল চলে গেলেও আরেক দল ঠিকই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। আছে বিএনসিসি, রোভার স্কাউট। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় উদীচী, রণ
সাহিত্য সংগঠন গুনগুন, আর সাংস্কৃতিক সংগঠন রণন মিলে প্রতিবছর ক্যাম্পাসে সাত দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে। সৃজনশীল আড্ডা কিংবা নানা কর্মশালার আয়োজন করে বিছনবাড়ি নামে আরও একটি দল। সৈয়দ শামসুল হক চর্চাকেন্দ্র নিয়মিত-অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে। শিক্ষক শফিক আশরাফের সম্পাদনায় মুগুর নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হয়। ক্যাম্পাস থেকে রণন প্রাঙ্গণ নামে প্রকাশিত হয় একটি সাহিত্য পত্রিকা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনভিত্তিক ক্যাম্পাস রেডিওর পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের উদ্বোধন হয়েছে ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে রেডিওর কার্যক্রম শুরু হয়। মহামারিকালে দীর্ঘ বিরতি পড়ে গেলেও এ মাসেই আবার রেডিও চালু হবে বলে জানালেন উপাচার্য হাসিবুর রশীদ।
নারী জাগরণের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়ার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাই তাঁর জীবন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে বাংলা বিভাগের শিক্ষকেরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন। দল বেঁধে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত তাঁরা চলে যান পায়রাবন্দে, বেগম রোকেয়ার বসতভিটা পরিদর্শনের জন্য। অন্যান্য বিভাগে এ ধরনের কার্যক্রম না থাকলেও শিক্ষার্থীরা অনেকে নিজেদের উদ্যোগে যান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগেই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে একটি কোর্স চালু করা উচিত বলে মনে করেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা মনে করেন, ক্যাম্পাসের মাঝখানে স্বাধীনতা স্মারকটিকে ঘিরে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মুক্ত মঞ্চে নাটক, কবিতা, গানে ক্যাম্পাস মুখরিত রাখতে পারবেন তাঁরা। ক্যাফেটেরিয়ার পরিবেশ আরও উন্নত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করলেন কয়েকজন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির কার্যক্রম পুরোদমে চালু করার দাবিও জানালেন শিক্ষার্থীরা।
অদম্য মেধাবী রেনু ফাতেমা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। অনেক সংগ্রাম, কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। এরপর যোগ দেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক হিসেবে।
মুঠোফোনে রেনু বলছিলেন, ‘আমার এই পড়াশোনার পেছনে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অবদান আছে। অদম্য মেধাবী হিসেবে বৃত্তি পেয়েছি বলেই এত দূর আসতে পেরেছি। এ ছাড়া আমার প্রাণের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান ভোলার নয়। আমি স্যারদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী বৃত্তি পাওয়া বেরোবির আরেক শিক্ষার্থী বর্ষা রানীও বাংলা বিভাগ থেকে পাস করে লালমনিরহাট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বেরোবির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী শেখ শাহাজাহান মিয়া মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে পড়ান, দ্বিতীয় ব্যাচের শাহাজাদা মিয়া পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক। সাহেদুল আলম নামের আরেক শিক্ষার্থী একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আছেন।সুইটি সরকার নামের এক প্রাক্তন ছাত্রী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় ফলিত গণিত বিষয়ে গবেষণা করছেন। বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিস অ্যান্ড ইকোনমিকসে গবেষক হিসেবে আছেন আরেক প্রাক্তন ছাত্রী আরিফা পারভীন।
প্রায় ১০০ বছর আগে নারীদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে লড়াই করে গেছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) স্নাতক রেনু ফাতেমা, বর্ষা রানী, সুইটি সরকারদের সঙ্গে দেখা হলে আজ তিনিই বোধ হয় সবচেয়ে খুশি হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স মাত্র ১৩ বছর। এরই মধ্যে প্রাক্তন ছাত্রীদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, কেউ সরকারি দপ্তরে কাজ করছেন, কেউবা গবেষণায় যুক্ত আছেন দেশের বাইরে। সুনামের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন বেরোবির প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।
রংপুর অঞ্চলে তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বইমেলা, সবই জমে ক্যাম্পাস ঘিরে। তা ছাড়া সবুজে ঘেরা পরিবেশে বুকভরে দম নিতে হাজির হয়ে যান অনেক দর্শনার্থীও।
৮ ও ৯ জুন ক্যাম্পাস ঘুরে কথা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শুনলাম তাঁদের স্বপ্ন, ভালো লাগা, পাওয়া না পাওয়ার কথা।
২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর এটি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে। শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন হয় ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল। পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম ক্যাম্পাস ছিল রংপুর শহরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ে। সে সময় ছয়টি বিভাগে মাত্র ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় পাঠদান। এরপর ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি নগরের পার্ক মোড়ের পাশে ৭৫ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে বর্তমান ক্যাম্পাস।
এখন ৬টি অনুষদে, ২২টি বিভাগের প্রায় ৯ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। শিক্ষক আছেন ১৮৬ জন। ক্যাম্পাসে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন ছাড়াও ছাত্রীদের থাকার জন্য আছে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল আর ছেলেদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শহীদ মুখতার ইলাহী নামে দুটি হল। ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা নামে আরও একটি হলের নির্মাণকাজ চলছে।
কদিন আগেও শিক্ষার্থীদের অন্যতম বড় অভিযোগ ছিল সেশনজট। করোনাকালে এই জট আরও প্রকট হয়। এখন ধীরে ধীরে সমস্যা কাটিয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী অপূর্বকৃষ্ণ রায় বলছিলেন, ‘যেভাবে সেশনজটে পড়েছিলাম, ভয় হচ্ছিল অনেক পিছিয়ে যাব। কিন্তু এক বছরের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষাগুলো হয়ে গেল। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিক সীমানাপ্রাচীরে ঘেরা। প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রথমেই চোখে পড়বে খোলা মাঠ। পাশেই পুলিশ ফাঁড়ি। গাছগাছালির ছায়ায় চারটি একাডেমিক ভবন আর প্রশাসনিক ভবনও ঢাকা পড়েছে।
স্বাধীনতা স্মারক থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, গাছগুলোর নিচে ছোট ছোট দলে বসে আছে শিক্ষার্থীরা। অনেকের আবার কাঁধে ব্যাগ কিংবা খাতা হাতে ছুটছিলেন একাডেমিক ভবনের দিকে।
প্রায় ৩০০ প্রজাতির ছোট-বড় গাছ আছে এই ক্যাম্পাসে। আলাদা করে ৩৬ হাজার গাছ লাগানোর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুর জামানের সঙ্গে কথা হলো। ভালো বিতার্কিক হিসেবে ক্যাম্পাসে তাঁর পরিচিতি আছে। বলছিলেন, ‘এখনো অনেক দিন ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কৃতি চর্চা করতে চাই। পড়া শেষ করে চলে গেলেও যেন ক্যাম্পাসের স্মৃতিতে নাম জড়িয়ে থাকে, এমন কিছু ভালো কাজ করে যেতে চাই।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রওনক জাহান বলেন, ‘সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাস আমাদের বারবার টানে। ক্লাস শেষের ক্লান্তি নিয়ে বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি করলে মন ভালো হয়ে যায়। ক্যাম্পাস আমাদের অনেক দিয়েছে। কিছুটা হলেও তো ঋণ শোধ করতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কিছু করার চেষ্টা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কোনো মিলনায়তন নেই। স্বাধীনতা স্মারকে উন্মুক্তভাবে নানা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ক্যাম্পাসের ক্লাবগুলো সারা বছর মাতিয়ে রাখতে চেষ্টা করে এই প্রাঙ্গণ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক আয়োজন থেকে শুরু করে বিতর্ক, রক্তদান, বইমেলা আয়োজনের মতো নানা কিছুতে নেতৃত্ব দেয় এসব ক্লাব। বিতর্ক নিয়ে কর্মশালা হয় নিয়মিত।
নিয়মিত রক্তদান করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বাঁধন’। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, প্রাণের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে একদল চলে গেলেও আরেক দল ঠিকই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে। আছে বিএনসিসি, রোভার স্কাউট। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় উদীচী, রণ
সাহিত্য সংগঠন গুনগুন, আর সাংস্কৃতিক সংগঠন রণন মিলে প্রতিবছর ক্যাম্পাসে সাত দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করে। সৃজনশীল আড্ডা কিংবা নানা কর্মশালার আয়োজন করে বিছনবাড়ি নামে আরও একটি দল। সৈয়দ শামসুল হক চর্চাকেন্দ্র নিয়মিত-অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে। শিক্ষক শফিক আশরাফের সম্পাদনায় মুগুর নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হয়। ক্যাম্পাস থেকে রণন প্রাঙ্গণ নামে প্রকাশিত হয় একটি সাহিত্য পত্রিকা।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনভিত্তিক ক্যাম্পাস রেডিওর পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের উদ্বোধন হয়েছে ২০১৯ সালের ১৭ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে রেডিওর কার্যক্রম শুরু হয়। মহামারিকালে দীর্ঘ বিরতি পড়ে গেলেও এ মাসেই আবার রেডিও চালু হবে বলে জানালেন উপাচার্য হাসিবুর রশীদ।
নারী জাগরণের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়ার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাই তাঁর জীবন সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে বাংলা বিভাগের শিক্ষকেরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়েছেন। দল বেঁধে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নিয়মিত তাঁরা চলে যান পায়রাবন্দে, বেগম রোকেয়ার বসতভিটা পরিদর্শনের জন্য। অন্যান্য বিভাগে এ ধরনের কার্যক্রম না থাকলেও শিক্ষার্থীরা অনেকে নিজেদের উদ্যোগে যান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগেই বেগম রোকেয়াকে নিয়ে একটি কোর্স চালু করা উচিত বলে মনে করেন অনেক শিক্ষার্থী।
বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা মনে করেন, ক্যাম্পাসের মাঝখানে স্বাধীনতা স্মারকটিকে ঘিরে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে মুক্ত মঞ্চে নাটক, কবিতা, গানে ক্যাম্পাস মুখরিত রাখতে পারবেন তাঁরা। ক্যাফেটেরিয়ার পরিবেশ আরও উন্নত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করলেন কয়েকজন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির কার্যক্রম পুরোদমে চালু করার দাবিও জানালেন শিক্ষার্থীরা।
অদম্য মেধাবী রেনু ফাতেমা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। অনেক সংগ্রাম, কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। এরপর যোগ দেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক হিসেবে।
মুঠোফোনে রেনু বলছিলেন, ‘আমার এই পড়াশোনার পেছনে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অবদান আছে। অদম্য মেধাবী হিসেবে বৃত্তি পেয়েছি বলেই এত দূর আসতে পেরেছি। এ ছাড়া আমার প্রাণের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান ভোলার নয়। আমি স্যারদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
প্রথম আলোর অদম্য মেধাবী বৃত্তি পাওয়া বেরোবির আরেক শিক্ষার্থী বর্ষা রানীও বাংলা বিভাগ থেকে পাস করে লালমনিরহাট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।
দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বেরোবির প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী শেখ শাহাজাহান মিয়া মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে পড়ান, দ্বিতীয় ব্যাচের শাহাজাদা মিয়া পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক। সাহেদুল আলম নামের আরেক শিক্ষার্থী একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আছেন।সুইটি সরকার নামের এক প্রাক্তন ছাত্রী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় ফলিত গণিত বিষয়ে গবেষণা করছেন। বুদাপেস্ট ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিস অ্যান্ড ইকোনমিকসে গবেষক হিসেবে আছেন আরেক প্রাক্তন ছাত্রী আরিফা পারভীন।