দেশের নিরক্ষর মানুষের মুখে নয়, বরং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মুখেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা হরহামেশা শোনা যাচ্ছে। আমার সবাই জানি, দ্রব্যমূল্যের বাজার নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীদের দখলে। ইচ্ছেমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কোনোভাবেই এদের লাগাম টানা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এতটাই করুণ যে, পবিত্র রমজান মাসেও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমছে না!
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরকে লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হতে পারে অনেকের কাছে। রাজধানীর হাতিরঝিলকে অনেকের কাছে প্যারিস শহর বলে মনে হতে পারে। দেশে নির্মিত বিপুলসংখ্যক ফ্লাইওভার, সেতু, রাস্তাঘাট, ফুটপাত দেখলে মনে হয়—আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি। কিন্তু রাস্তায় নামলে ফাঁকা পকেটে বাসায় ফিরতে হয় দিন শেষে। দেশে এমন কোনো জিনিস নেই, যার দাম নিম্নমুখী!
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী জিনিসপত্রের দাম অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে—এ কথা যেমন সত্য, তেমনিভাবে নানা অজুহাতে দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা—এ কথার বাইরে যাওয়ারও উপায় নেই।
এ কথা অনস্বীকার্য, বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষণীয়। তবে সারা বিশ্বে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রব্যমূল্য বাড়লেও স্থিতিশীল পরিবেশে তা কমেও যায়। কিন্তু আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা আর কোনো বিবেচনাতেই কমে না। এমনটা কেন হবে? এটা কি কোনো সভ্য সমাজের লক্ষণ হতে পারে?
একজন শ্রমিক সারা দিনে যে মজুরি পায় তা দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার কত অংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়—আজকের দিনে সেটাই ভাববার বিষয়। একসময় বলা হতো, শ্রমিকের মজুরির ৬০ থেকে ৬৬ শতাংশই খাদ্য সংগ্রহে ব্যয় হয়ে যায়। বিশ্বাস করি, এখন নতুন কোনো সমীক্ষা পরিচালিত হলে এই শতাংশের হার আরো বৃদ্ধি পাবে। তার পরও যদি ধরে নেওয়া হয় এখনো ৬৬ শতাংশই খাদ্যের পেছনে খরচ হয়, তবে প্রশ্ন করা যায়, বাকি ৩৪ কিংবা ৪০ শতাংশ অর্থ দিয়ে বাকি মৌলিক চাহিদাগুলোর কত শতাংশ পূরণ করা সম্ভব? তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে আস্ফাালন করার কোনো পরিবেশ এখনো দেশে সৃষ্টি হয়নি। সত্যি বলতে, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তা এখনো সাধারণ মানুষ জানে না। দায়িত্বসংশ্লিষ্টরা সবাই শুধু নিজেদের মতো করে বাণী আউড়িয়ে যায়। দেশে পণ্যের কোনো সংকট নেই, প্রয়োজনীয় মজুত আছে—এমন কথা কর্তৃপক্ষের মুখে যেন চিরচেনা বাণী!
কিছু দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ব্যক্তির পোস্ট ভাইরাল হয়। তাতে লেখা ছিল এরকম—‘২০ টাকার চাল খাচ্ছি ৮৫ টাকায়, ৭০ টাকার সয়াবিন ২১০ টাকায়, ২০০ টাকার গরুর মাংস খাচ্ছি ৭৫০ টাকায়, ৩ টাকার ইউরিয়া সার কিনছি ৪০-৫০ টাকায়।’ বাস্তবিক অর্থে, এই কথার সঙ্গে কেউ দ্বিমত করতে পারবেন?
প্রতি বছর পেঁয়াজের নাটক মঞ্চস্থ হয়। জোটবদ্ধভাবে সংশ্লিষ্টরা বাণী প্রচারে নিবেদিত হয়ে পড়েন—‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে। দ্রব্যের কোনো সংকট নেই, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’ এমনও বলা হয়, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে উসকানি দিচ্ছে বিরোধী দল।’ বস্তুত, প্রত্যেকটা রসিকতারই একটা সীমা আছে। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার দম্ভে পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনা ভুলতে বসেছেন। বর্তমান সময়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় পড়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের যে জীবনসংগ্রাম চলছে তা বোঝার ন্যূনতম মানসিক অবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। চারদিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জয়জয়কার—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার ছড়াছাড়ি! দেশ ও মানবপ্রেম, সাধারণ মানুষের অবস্থা ও অবস্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, পরিবেশ ও পরিস্থিতি এখানে যেন একেবারেই বিবেচ্য নয়! যাহোক, নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম থেকে নিষ্কৃতি চাই। দ্রব্যমূল্যের বাজারে সিন্ডিকেট গেড়ে বসা অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে বড় মহলের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ চাই।