পর্ব-১

১৯৭১ এর নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ আমি যে ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি সেই স্মৃতিটুকুই তুলে ধরতে চাই। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমি যা দেখেছি শুনেছি সেই সত্যটুকুই তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করছি। কিশোর বয়সে দেখা নয় মাসের সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই। আর কেনইবা চাই তারও একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তারাই অত্যন্ত সুকৌশে আওয়ামীলীগ-বিএনপি‘র কাঁধে ভর করে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করছে। শুধু ইতিহাস বিকৃতিই নয় নতুন করে কোন কোন মহলকে বলতে শুনি বাংলাদেশ নাকি ইসলামিক রাষ্ট্র! সব অতীতকে মুছে ফেলতে হবে, এসব শুনলে মনে দারুন কষ্ট পাই। যারা এসব বলে তারা জাতীয় সঙ্গীত পছন্দ করেনা, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে এদের শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানাতেও দেখা যায়না। (নব প্রজন্মের যারা এসব বলে আমি মনে করি তাদের বাপদাদারা এদেশেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলনা।) মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। জয় বাংলা বলতে দ্বিধাবোধ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যার পর এরাই সব থেকে বেশী আনন্দিত হয়েছিল। সবার প্রতি আমার অনুরোধ যে যেভাবে ১৯৭১ সালকে প্রত্যক্ষ করেছেন সেই বিষয়টুকু তুলে ধরুন। আপনার এলাকায় বা আপনি তখন কি করতেন কোথায় ছিলেন এই বিষয়টুকুই তুলে ধরুন এর মাধ্যমে উঠে আসবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস।
একাত্তর নিয়ে আলোচনা শুরু করার পূর্বে আমাকে ফিরে যেতে হবে ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে। আমি কিন্তু এই অধ্যায়ে সমগ্র দেশের কথা বলছিনা, আমার নিজ এলাকা আশপাশ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, সাক্ষাৎকার ও গণমাধ্যমের বদৌলতে যা জেনেছি ও সংগ্রহ করেছি এবং নিজ চোঁখে যা প্রত্যক্ষ করেছি সেই সব নিয়ে আলোচনা করব। লিখার বিষয় আমার নিজ এলাকা ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের আংশিক এবং সমগ্র বাংলাদেশের খন্ডচিত্র।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও এগার দফা আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন। শহর থেকে শুরু করে গ্রামে গঞ্জে ৬দফা ও ১১ দফার সমর্থনে আলোচনা সমালোচনা মিছিল মিটিং দেখা যেত। তখনকার সময়ে আজকের মত যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিলনা। শহর থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দলবদ্ধ হয়ে গ্রামে আসতেন গ্রামাঞ্চলের মানুষদের সচেতন করতে। এই আন্দোলনে ভীত নড়ে যায় সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসেন আরেক শাসক ইয়াহিয়া খান। তখন দেশের সর্বত্র শ্লোগান শোনা যেত ‘‘জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো’’। ‘‘ছয় দফা ১১দফা মানতে হবে মানতে হবে”। “আইয়ব মোনায়েম ভাই ভাই এক রশিতে ফাঁসি চাই।“ ঠিক এই সময় গ্রামেগঞ্জে দেশের অনেক স্থানে আইয়ব খান সমর্থিত চেয়ারম্যানদের বাড়ীঘর ভেঙ্গে দেয় ছাত্ররা। আমাদের এলাকায়ও বর্তমান তিন-নং-সাবেক-২নং ইনাতগঞ্জ ই্উনিয়ের চেয়ারম্যান সাওমিয়া চৌধুরীর মোস্তফাপুর গ্রামে বাড়ী গুড়িয়ে দেয় ছাত্ররা। আমাদের এলাকার তৎকালীন কলেজ ছাত্র বনকাদিপুরের মনর উদ্দিন প্রতিদিন গ্রামের বাজারে লাউড স্পীকার নিয়ে ছয় দফার পক্ষে প্রচার করতেন। আমরাও প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র মাঝে মধ্যে বড়দের সাথে মিছিলে যেতাম।
তখন সারা বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মানতো। তিনি যা বলতেন তাই হতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠেন হ্যামিলনের বংশী বাদক। কারাগার থেকে মুক্তিপান বঙ্গবন্ধু, আসলো ১৯৭০ এর সাধারণ নির্চাবন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্টতা লাভ করে আওয়ামীলীগ। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে চট্রগ্রামের রাজা ত্রিবিদ রায় চাকমা স্বতন্ত্র এবং ময়মনসিংহের নূরুল আমিন পিডি থেকে নির্বাচিত হন। এছাড়া সকল সিটে আওয়ামীলীগ প্রার্থিরা বিজয়ী হন। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে আমার এলাকা নবীগঞ্জ থেকে হাতী প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল আজিজ চৌধুরী ও দিরাই থেকে ন্যাপের প্রার্থী কুড়েঘর প্রতিক নিয়ে বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বিজয়ী হন। এছাড়া পূর্বপাকিস্তানে (বাংলাদেশে) প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আরো তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামীলীগ দুটি আসনে জয়লাভ করে।
তখন আজকের মতো স্বাধীনতা বিরোধী জামাতে ইসলামী এতটা শক্তিশালী ছিলনা। প্রতিটি আসনে আওয়ামীলীগের বিপরিতে মুসলিমলীগ, পিডিপি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রর্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুদ্ধ শুরু হলে দলগত ভাবে জামাতে ইসলাম, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলাম ও পিডিপি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। দলগত ভাবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পকিস্তানের পক্ষ না নিলেও যারা আওয়ামীলগের বিরোধীতা করেছিল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও তার সমর্থকরা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় এবং গণহত্যায় পাকবাহিনীকে সহায়তা করে। তাদের অন্যতম ছিল বালাগঞ্জের গহরপুরের মুফতি নূরউদ্দিন। এই নূর উদ্দিন জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর সাথে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তার নেতৃত্বে তার গহরপুর কৌমি মাদ্রাসা থেকে তৈরী হয় কয়েক হাজার রাজাকার সদস্য। শ্রীরামসী গণহতা সহ বৃহত্তর সিলেটর প্রতিটি গণহত্যায় গহরপুর মাদ্রাসার যেসব ছাত্ররা রাজাককার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তারা অংশ নেয়।
আমি তখন ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে ষষ্ঠশ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে গ্রামের বাড়ীতে ফিরে এসেছি। তখন সমগ্র দেশে বইছে আনন্দের বন্যা। কখন বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্থান্তর করবে এহিয়া খান। পাকিস্তানী সামরিক শাসক টালবাহনা শুরু করলো আজ-কাল পরশু ইত্যদি।
৭০ এর নির্বাচনে আমার নির্বাচনী এলাকা নবীগঞ্জ-বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ নিয়ে জাতীয় পরিষদ আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন মুত্তিযুদ্ধের সহসেনাপতি কর্ণেল (অবঃ) এম. এ. রব, তার প্রতিক ছিল নৌকা, তার প্রতিদন্দি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী বানিয়াচংগের অবসর প্রাপ্ত জেলা জজ রশিদুল হাসান। যিনি ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও মোয়াজ্জম হাসানের চাচা, তার প্রতিক ছিল খেজুর গাছ। নেজামে ইসলামের প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ কামরুল হাসান তার প্রতিক ছিল বই ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন আজমিরীগঞ্জের রফিক উদ্দিন তার প্রতিক ছিল আম। এই আসনে মূলত এই চার জনের মধ্য প্রতিদন্দিতা হয়।
প্রাদেশিক পরিষদ নির্বানে নবীগঞ্জ থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রী মোদাব্বির হোসেন চৌধুরীর পুত্র বিশিষ্ট শিল্পপতি ইসমত আহমদ চৌধুরী, নেজামে ইসলাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী ছিলেন দিনারপুরের মুফতি আব্দুল হান্নান তার প্রতিক ছিল বই, জামাতে ইসলামের প্রার্থী ছিলেন রাইয়াপুরের আবু আবদিল্লা মোহাম্মদ ইসমাইল (ইসমাইল মৌলানা) তার প্রতিক ছিল দাড়ি পাল্লা, স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন নবীগঞ্জ জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ চৌধুরী, তার প্রতিক ছিল হাতি, মুসলীমলীগের প্রার্থী ছিলেন গুলডোবার ছাদ উদ্দিন চৌধুরী এডভোকেট তার প্রতিক ছিল হারিকেন, এই আসনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নৌকা এবং হাতির মধ্যে। মাত্র ১৩০ ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থি বিজয়ী হন। ১৯৭১ সালে জামাতের পরাজিত প্রার্থি মৌলনা ইসমাইলের নেতৃত্বে এই এলাকায় গড়ে উঠে শান্তি কমিটি, নবীগঞ্জের গণহত্যা সহ এই এলাকায় প্রতিটি হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুট পাটের অন্যতম নায়ক ছিল এই মৌলানা ইসমাইল। দেশ স্বাধীনের পর সে আশ্রয় নেয় আমেরিকায় সেখানেই মৃত্যুবরণ করে।
(এখানে আরেকটি কথা অবশ্যেই উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না হয় লেখাটি অসম্পূর্ন থেকে যাবে-সিলেট অঞ্চলে আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠা পায় দেওয়ান ফরিদ গাজীর হাত ধরে এর পেছনে অর্থ ব্যয় করেছেন ইসমত আহমদ চৌধুরী। আজও প্রবীণদের মুখে এই কথাটিই বার বার শোনা যায় ফরিদ গাজী বাড়ি বাড়ি গিয়ে আওয়ামীলীগের পক্ষে প্রচারণা করেছেন টাকা খরচ করেছেন ইসমত চৌধুরী। এছাড়া অন্যদিকে ব্ঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক তাঁকে মুক্ত করতে লন্ডন থেকে নবীগঞ্জের সন্তান প্রবাসী নেতা আব্দুল মন্নান ছানু মিয়া ব্যারিস্টার টমাস উইলিয়ামকে পাঠিয়েছিলেন আইনজীবি হিসেবে। লন্ডন থেকে কিউসী আসাতে মামলার মোড় ঘুড়ে যায় মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সিলেট আসলে থাকতেন ইসমত চৌধুরীর বাসায়, এ ছাড়া ইসমত চৌধুরীর পিতা মদব্বির হোসেন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিজের পুত্রের মত স্নেহ করতেন সম্বোধন করতে মুজিব বলে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নবীগঞ্জের আসনে ইসমত চৌধুরীকেই আওয়ামীলীগের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। ছানু মিয়া মনোনয়ন না পেয়ে তার বিপরিতে সতন্ত্র হিসেবে নবীগঞ্জ জে.কে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ চৌধুরীকে দাড় করান। পরবর্তিতে অবশ্য ১৯৭৩ সালে ছানু মিয়াকেই আওয়ামীলাগের প্রার্থি করা হয় এই আসনে। এই আব্দুল আজিজ চৌধুরী জাসদ থেকে মশাল প্রতিক নিয়ে ছানু মিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। আর এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য একটি কঠিণ পরীক্ষা। এ যেন ঠিক, সাম রাখি না কুল রাখি।)
বঙ্গবন্ধু নূরুল আমিন ব্যতিত আওয়ামীলীগের প্রার্থীদের শপথ পাঠ করালেন তার সাথে স্বতন্ত্র যে পাঁচজন বিজয়ী হয়েছিলেন তারাও শপথ নিলেন। এই শপথ অনুষ্ঠান রেডিওতে প্রচার করা হয়। তারিখটা আমার মনে নেই।
পাকিস্তানীদের টালবাহনা দেখে কারো বুঝতে বাকি রইলনো এরা সহজে ক্ষমতা দিবেনা বাঙ্গালীদের হাতে। এভাবে চলতে থাকে আলোচনা। ৩ মার্চ ছাত্র লীগের নেতারা আ.স.ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। দেশের মানুষ ভাবতে শুরু করলো হয়তোবা দেশে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতে পারে। এই চিন্তা সকলের, কেউ কেউ বাজার সওদা মওজুদ করতে লাগলো। গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক কুসংস্কার আজও আছে। তখন বয়স্ক অনেককেই বলতে শুনেছি দেশে বড় ধরণের একটি রক্তক্ষয় হতে পারে। তারা আলাতম হিসেবে বলতেন, দেখ পশ্চিম আকাশে লাল হয়ে সূর্য ডুবেছে। আর কেউ বলতেন দেখ খাল-বিল-নদী নালার পানিতে লাল গেউর জমেছে। এটি নাকি রক্তপাতের লক্ষণ। তাদের এজাতীয় ভবিষ্যৎবাণী সঠিক ছিল, পরবর্তিতে তা প্রমানিত হয়েছে।
আমি সিলেট শহরে মডেল স্কুলে পড়ি, বাবা প্রতিদিন বলতেন চলে যাও। মা এবং অন্যান্যরা বলতেন দেখ দেশের অবস্থা কোন দিকে গড়ায় তার পরে না হয় যাওয়া যাবে। এভাবে চলে দিন। আমার আরেকটা শখ ছিল পলবাওয়া, (পলোবাওয়া মানে পলো দিয়ে মাছ শিকার) আমাদের গ্রামে মাঘ মাসের শেষ দিকে চাওখা বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরা হয়, আমার ইচ্ছে পলোবাওয়া শেষ হলে যাব কেননা ক্লাস শুরু হতে সময় আছে। কিছু বাদ পরলে পড়ে পুষিয়ে নেব।
চলে আসল মার্চের সাত তারিখ, যেহেতু পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা করছে কারো বুঝতে বাকী রইলনা যে বাঙ্গালীদের বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এখানে আরেকটি কথা বলতে ভূলে গিয়েছি ৭০এর নির্বাচনের পরপরই প্রতিদিন ঢাকা রেডিও থেকে দেশাত্মবোধক গান বাজানো হত। ’’শোন শোন লোকে বলে শোন যত খাটি আমার বাংলাদেশের মাটি’’ জয় বালা, বাংলার জয় ইত্যাদি গান।‘’ তখনকার সময় গ্রামাঞ্চলে টেলিভিশন ছিলনা এমনকি সকল বাড়ীতে রেডিও ছিলনা। আমাদের পরিবারটি সচেতন আমার বাবা-চাচারা নিয়মিত রেডিও শুনতেন এমনকি পত্রিকা পড়তেন পত্রিকা আসত ডাকে, দৈনিক আজাদ এবং ইত্তেফাক আসত আমাদের বাড়ীতে। রেডিও নিয়ে সকলে বসলেন আমাদের বাংলোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করা হবে। দুর্ভাগ্য বসত ওইদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ঢাকা রেডিও থেকে প্রচার করা হলো না। প্রচার করা হল পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ সকালে। সকলেই ধারণা করেছিলেন হয়তো বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। তিনি বললেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, জয় বাংলা।
আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তুমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর। প্রতিটি পাড়ায় মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোল। বাঙ্গালী নন বাঙ্গালী সকলেই আমাদের ভাই। এর পর দিন থেকেই গ্রামে গঞ্জে শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। আমার বেশ মনে আছে আমাদের বাড়ীতে রেডিও শুনতে আসতেন গ্রামের সব মানুষ। (সেই ভাষণ শুনে আমাদের গ্রামের রিয়াসত উল্লা নামের সহজ সরল এক কৃষক বাবাকে প্রশ্ন করলেন আশা করে এসেছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণা শুনব কি করলেন বঙ্গবন্ধু – বাবা তাকে বললেন এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু ডিরেক্ট বললে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যাবেন কৌশল অবলম্বন করেছেন-যাও বাড়ী গিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।) আনসার সদস্য এবং সাবেক সেনা সদস্যরা গ্রামেগঞ্জে ট্রেনিং শুরু করলেন। আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীওয়ালা- গ্রামের কৃষক-শ্রমিক, জেলে, নৌকার মাঝি সকলেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ল। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকেই জাতির পিতাকে স্বচক্ষে দেখেনি। কেননা সেসময় সকলের বাড়ীতে টেলিভিশন ছিলনা, গ্রামেতো দূরের কথা শহরেও টেলিভিশন ছিল হাতগোনা কয়েকটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর কথায় তৎকালীন বাঙ্গালীদের যারা আনসার-পুলিশ, সেনাবাহিনী বা অন্যান্য বিভাগে সরকারী চাকুরী করতেন তাদের ৯৯%ই ছিল বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। জেলে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়নি, চাষী লাঙ্গল চালায়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতো পূর্ববাংলা। দিন যত ঘনিয়ে আসলো মানুষের উদবেগ আর উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে কি হচ্ছে এই চিন্তা, আমাদের পরিবারের একটি অংশ তখন চাকুরী এবং ব্যবসার সুবাদে থাকতেন দেশের বিভিন্ন স্থানে, চট্রগামেই ছিলেন বেশী।
তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধের জন্য ভেতরে ভেতরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমাদের চাচাত ভাই গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী পাকিস্তান আর্মির সিগন্যাল কোরে ঢাকা সেনা নিবাসে কর্মরত| বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে অত্যন্ত কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাড়াও, শত্রুর মোকাবেলা কর। এর পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ১৯৭১এর মার্চ মাসের ১৫ তারিখ স্ত্রী সন্তানকে কেন্টনমেন্টে রেখে লাপাত্তা হয়ে যান। ১৮ মার্চ ঢাকা সেনা নিবাস থেকে গ্রামের বাড়িতে তার ভাই মরতুজা আহমদ চৌধুরীর নামে একটি টেলিগ্রাম আসে গিয়াস আহত। তিনি যেন টেলিগ্রাম পাওয়ার ৪৮ঘণ্টার ভেতর মার্শাল‘ল অ্যডমিনিস্ট্রাটর টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। তখন সবার মাঝে আতঙ্ক দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। তার ভাই মুর্তুজা আহমদ চৌধুরী ঢাকায় গেলে তাকে আটক করে টিক্কা খান। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী দেশের নীরিহ মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এর ভেতর তার ভাতিজা মনির গিয়স উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী খালেদা চৌধুরী ও শিশু কন্যা লাকিকে নিয়ে সেনা নিবাস থেকে পালিয়ে আসেন। তারাও ১২দিন পায়ে হেটে যুদ্ধের ভেতর ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরেন। মোরতজা আহমদ চৌধুরী জল্লাদ টিক্কা খানের কাছ থেকে কোন ক্রমে পালিয়ে আসেন।
২৫তারিখ রাত ১২টায় বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়ারলেস মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বাসায় অবস্থান করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পাকিস্তান রেডিও থেকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুকে এরেষ্ট করা হয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের ভেতর শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। অন্যদিকে আকাশবাণী কলকাতা থেকে বার বার ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন। আকাশ বাণী থেকে এসব প্রচারের অন্য কারণ ছিল যাতে সাধারণ মানুষের মনোবল না ভাঙ্গে।
এখানে আরেকটি কথা পরিস্কার করতে চাই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যেসব নেতা-কর্মি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে গণহত্যা ও লুটপাটে অংশ নেয় তার প্রধান ছিল বালাগঞ্জের গহরপুরের নূর উদ্দিন, যে সিলেট অঞ্চলে মুফতি নূর উদ্দিন হিসেবে পরিচিত। সে এবং তারা অনুসারীরা সিলেট অঞ্চলে গণহত্যায় পাকিস্তান বাহিনীকে সহায়তা করে। জমিয়তের সকল নয় শুধুমাত্র নূরুদ্দিন অনুসারীরাই। এদের আরেকটি পরিচয় আছে যারা সিলেট বিভাগে জোয়াল্লিন পন্থি হিসেবে পরিচিত। একসময় সিলেট বিভাগের প্রতিটি গ্রামে জোয়াল্লি এবং দোয়াল্লিন নিয়ে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করত, এনিয়ে এই অঞ্চলে বহু খুন খারাবি মামলা মোকদ্দমা এবং মারামারির ঘটনাও কম হয়নি। এখন এই ফেতনা আর শুনা যায়না।
দেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে মে মাসের শুরুর দিকে এই নূরউদ্দিন তার অনুসারীদের পাকিস্তানের পক্ষে দাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করলে মুক্তি বাহিনীর হাতে আটক হয় নূর উদ্দিন। তাকে গ্রেফতার করেছিলেন পাঁচ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, তখন সে প্রাণ ভিক্ষা চায় এবং ওয়াদা করে আর এসব করবেনা। মুক্তিবাহিনী তাঁকে ছেড়ে দিলে তার অনুসারীরা প্রচার করতে থাকে মুফতি সাহেবকে মুক্তিবাহিনী ধরে নিতে চাইলে সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে কারো পেটে ব্যাথা কেউ কেউ চোঁখে দেখছিলনা এসব কারণে সকলে তার কাছে ক্ষমা চায় তিনি তাদের মাফ করে দেন। আসল রহস্য জানা গেলে যুদ্ধ শেষে মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বাড়ী ফিরলে। তিনি বলেন সে নূরী চৌধুরী সহ সিলেট অঞ্চলের কয়েকজন আলেমের দোহাই দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। নতুবা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাকে সাথে সাথেই হত্যা করত। এই ধর্মব্যবসায়ীরা এভাবেই অপপ্রচার করে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে প্রতিটি গণহত্যার সাথে এই নূরউদ্দিন জড়িত তার তৈরীকরা রাজাকার বাহিনী অংশ নেয়। তার নিজ এলাকা খাইগতর গ্রামের এক ব্যক্তিকে এই নূর উদ্দিন গাজাখোর আখ্যাদিয়ে হত্যা করে এবং মৃত ব্যক্তির কান কাটে নিজ হাতে। এই হলো মুফতি নূর উদ্দিন। এই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এখনও জীবত ঢাকার সেনাকুঞ্জে বসবাস করতেন গেল বছর মৃত্যবরণ করে।
আমি মনেকরি শুধু আমি নয় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা। পাকিস্তান আর্মির প্রেস অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক তার বইয়ে এই কথাটি স্বীকার করেছেন। ৭ তারিখেই পাকিস্তান আর্মির পরিকল্পনা ছিল হামলা করা তারা প্রস্তুতও ছিল। তৎকালীণ ছাত্র নেতা আ.স. ম. আব্দুর রব তার এক সাক্ষাৎকারে পরিস্কার করে বলেছেন (যদিও তিনি পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা করেছেন।) বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন। এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। আ. স. ম আব্দুর রব আরো বলেছেন তিনি জয় পাকিস্তান বলেননি বলেছেন জয় বাংলা বলে ভাষণ শেষ করেছেন। আমি তার পায়ের কাছে বসা ছিলাম। এটি স্বাধীনতা বিরোধীদের অপপ্রচার। এই ভাষণটি এখনও সংরক্ষিত আছে। ( চলবে…)