
শেরপুর যুদ্ধঃ
বৃহত্তর সিলেটর মধ্যে শেরপুর একটি গুরুত্বপূর্ন নদীবন্দর, চার মহকুমার বর্তমান চার জেলার মিলনস্থল। ১৯৭১এর ২৫শে মার্চের আগেই বরবর পাকিস্তান বাহিনী শেরপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। ভৌগলিকভাবে শেরপুরের গুরুত্ব অসীম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের সময় এখানে সেনাঘাটি ছিল। ক্যাম্পের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রতি দিনই স্থানীয় অধিবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করলে- শেরপুর থেকে-সাদিপুর পর্যন্ত সড়কের আশপাশের মানুষ বাড়ি ছেড়ে দেশের অন্যত্র আশ্রয় নেয়। আর একারণেই শেরপুর তথা আমাদের এলাকাটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, কখন যে পাকিস্তানী সৈন্যরা কোন গ্রামে ঢুকে পড়ে বলা য়ায়না। তাই দিবারাত্রি গ্রামবাসীকে পালাক্রমে পাহাড়ায় থাকতে হত। প্রতিদিনই দেখা যেত পূর্বদিক থেকে শত শত নারী-পুরুষ শিশুসহ প্রাণ ভয়ে পশ্চিমে দৌড়াচ্ছে, আর বলছে ‘’পাঞ্জাবী আইছে-পাঞ্জাবী-আইছে‘‘ এই কথাটি শুনলেই মানুষজন পশ্চিমের দিকে পালাত, প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটত যুদ্ধ শুরুর প্রথমার্ধে। কোনকোন দিন এভাবে গুজব ছড়িয়ে দিত হেসেনপুর গ্রামের আফতাব চুরা নামের একজন চোর, মানুষজন বাড়িঘর ফেলে চলে গেলে সে এই সুযোগে লুট-তরাজ চালাত।
এর মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কমানডেন্ট মানিক চৌধুরী হবিগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসককে অস্ত্রাগার খুলে দিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানালে তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আদেশ করলেন তালা ভেঙ্গে অস্ত্রাগার খুলে দেওয়ার জন্য। তিনিও আর আপত্তি করেননি, তখন হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন (ব্রাম্মনবাড়িয়ার) সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান। মুক্তিকামীরা মানিক চৌধুরীর নির্দেশে তালা ভেঙ্গে অস্ত্রাগার লুট করে। তেলিয়াপাড়া থেকে (মুক্তিবাহিনী) সাবেক সেনা সদস্য, আনসার, ইপিআর ও পুলিশ শেরপুর আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। ৫এপ্রিল ভোররাত থেকে শোনা যাচ্ছিল গোলাগুলির শব্দ। তখন অনেকেই অনুমান করছিলেন কোথাও প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
ওই দিন আমাদের গ্রামের একজন প্রবীণ মূরব্বী আহমদ উল্লাহ মারা গেছেন। আমি আমার ছোট ভাই-বোনদের মক্তবে আনতে গেছি তখন সকাল সাড়ে সাত বা আটটা হবে। কয়েকজন ইপিআর সদস্য আহত হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে আমাদের বাড়ীর দিকে আসছিল অনেকেই প্রথমে মনে করছেন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আসছে। খাকি পোষাক দেখে সবাই পাঞ্জাবী মনে করে পালাতে থাকলে এ সময় আমাদের পশ্চিমের বাড়ীর হুসিয়ার আলীর মা দৌড়ে গেছেন মক্তব ঘরজুরে চিৎকার দিয়ে বললেন ‘’হুসিয়ার আলীরে মেলট্টরী আইছে।’’ এই কথা শুনে মসজিদের ইমাম সাহেব বাচ্চাদের রেখে দৌড়ে পালালেন আমি আমার ছোট ভাইবোনদের নিয়ে পেছন দিকে বাড়ীতে ঢুকে দেখলাম এরা পাঞ্জাবী নয় ইপিআর সদস্য সকলেই গুলিবিদ্ধ। আমাদের বাড়ীতে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, দেয়া হয় নাস্তা তার পর এরা পশ্চিম দিকে নবীগঞ্জের দিয়ে হাওর পথে রওয়ানা দেয়। তখন আমাদের গ্রামের মসজিদের ঈমাম ছিলেন বালাগঞ্জের আলিপুর গ্রামের মৌলানা আব্দুল অদুদ। এই ভদ্রলোক খুবই ভীত লোক ছিলেন।
(বর-কনেকে পাল্কীতে রেখে বর যাত্রীদের পালায়নঃ )
এখানে ঘটে আরেকটি মজার ঘটনা ওইদিন ছিল শ্রীধরপুরের মজাহিদ দর্জির বিয়ে। তিনি কনে নিয়ে শাদুল্লাপুর থেকে বাড়ী ফিরছিলেন। হাওর পথে লিলাম বাজারের কাছে স্বস্থিপুরের পশ্চিমে পৌঁছালে কে একজন চিৎকার দিয়ে বলছে ‘’পাঞ্জাবী আইছে”। বড়যাত্রীরা সামনের দিকে চেয়ে দেখলেন উর্দি পরা সৈনিকরা আসছে তারাও মনে করলেন পাকিস্তানী। সকলেই ভয়ে যার যার জান নিয়ে পালালেন, কেউ প্রবেশ করলেন জঙ্গলে আর কেউবা দৌড়ালেন দক্ষিন দিকে বহরমপুর গ্রামের দিকে। পাল্কীর পাশে দাড়িয়ে রইলেন বর পাল্কির ভেতর কন্যা। দেখা গেল পাঞ্জাবী নয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অভয় দিয়ে বললেন ভয় নেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমার মেজভাই মহিবুর রহমান চৌধুরীও ছিলেন বরযাত্রী। তিনি বাড়ী ফিরলে তার মূখ থেকে বরযাত্রীদের কনে রেখে পালানোর কথা জানা গেল। বরও কনে নিয়ে বাড়ী ফিরলেন।
তখন সকাল এগারটা বাজে, আমার চাচাত ভাই গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বাড়িতে এসে উপস্থিত। তিনিও শেরপুর আক্রমনে অংশ নিচ্ছেন। (আগেই বলেছি ১৫ মার্চের পরই তিনি কেন্টনমেন্ট থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পালিয়েছিলেন-তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিগনাল কোরে কর্মরত ছিলেন।) দুই পকেটে দুটি পিস্তল হাতে ওয়ারলেস। সবাই তার দিকে এগিয়ে আসলেন, জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধু কোথায়? তাঁর সোজা উত্তর গতকাল বঙ্গবন্ধুকে দাউদকান্দি ফেরি পার করে দিয়ে এসেছি। উপস্থিত সকলকে বললেন যুদ্ধে যাও। চার/পাঁচ মিনিটের ভেতর মা‘কে সালাম করে বেরিয়ে পড়লেন আর ফিরলেন দেশ স্বাধীনের পর। তাঁর এমনটি বলার কারণ ছিল মানুষের মনবল যাতে নাভাঙ্গে। দেশের অভ্যন্তরে চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধ, পাকিস্তান রেডিও থেকে বার বার বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্যদিকে আকাশবানী কলকাতা থেকে বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু মুক্ত আছেন। তাঁর এমনটি বলার কারণ ছিল সাধারণ মানুষের মনবল শক্তরাখা।

এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে চারিদিক থেকে সাধারণ মানুষ লাঠি সোটা নিয়ে শেরপুরের দিকে এগুতে থাকে। নবীগঞ্জ-দিনারপুর থেকে হাজার হাজার মানুষ অন্যদিকে লঞ্চেও ভাটি অঞ্চলের মানুষ লাঠিসোটা হাতে ছুটছে সবার গন্তব্য শেরপুর। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর। বঙ্গবন্ধুর আহবানই সম্বল। কেউ ভেবে দেখেনি আধুনিক অস্ত্রের সাথে লাঠি নিয়ে মোকাবেলা কি ভাবে করবে? নেতার নির্দেশ এবং মনবলইই যথেষ্ট। আমি আর আমার বন্ধু আবু ইউসুফ আমাদের বাড়ীর উত্তর দিকে মাঠের হিজল গাছে উঠে মানুষ জনের লাঠি হাতে শেরপুরের দিকে যাওয়া দেখে আমরাও প্রস্তুতি নেই সবার সাথে লাঠি নিয়ে যুদ্ধে যাব। তখন দেখলাম চতুরদিক থেকে মানুষজন লাঠি হাতে ছুটছে শেরপুরের দিকে। হাজার হাজার মানুষ। আমি যেতে চাইলে মা বললেন “তুই কোথায় যাবি? মানুষের পায়ের নীচে পড়ে মারা পরবি”। কে শোনে কার কথা, আমিও একটা তরি কুচা আর আবু ইউসুফ নিল একটা সুলফি, আমরাও দলের সাথে পারকুল পর্যন্ত গেলাম। সামনে শেরপুর পয়েন্ট উভয় দিকে গুলাগুলি চলছে। আর এগুনো যাচ্ছেনা। বিকেলের দিকে ফিরে আসলাম। সন্ধার আগ মূহুর্থে পাক বাহিনী শেরপুর ছেড়ে সাদিপুরের ফেরি পার হয়ে সিলেটে চলে যায়। আপদত মুক্ত হয় শেরপুর। স্থাপন করা হয় মুক্তিবাহিনীর ঘাটি। ওইদিন আমার মত লাঠি নিয়ে আসা কাতিয়ার হিরন খান গুলিতে আহত হয়েছিলেন।
শেরপুর থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পালালেও সমগ্র দেশে চলতে থাকে তাদের তান্ডব। ওই সময় রাজানামে তাজপুর গ্রামের এক চাঁদাবাজের আবির্ভাব ঘটে। সে প্রতিদিন শেরপুর এলাকায় নৌকা আটকিয়ে চাঁদাবাজি করত। বলত মু্ক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সাহায্য প্রয়োজন, সাহায্য দিয়ে যান। এভাবে চাঁদা সংগ্রহ করত। ভূক্তভোগীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নালিশ করলে মুক্তিবাহিনী ওই চাঁদাবাজকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এই মূহুর্থে আমরা নিরাপদে থাকলেও আমার বড় বোনের জন্যে মায়ের চিন্তার শেষ নেই কারণ আমার বোনের বাড়ী জেনারেল ওসমানীর বাড়ীর পাশে এমকি সড়কের কাছে। যেকোন সময় তাদের বাড়ীতে আক্রমন হতে পারে। এপ্রিলের ১০ তারিখ আমার বড় বোন হালিমা খাতুন চৌধুরীকে দয়ামির থেকে আনতে গেলেন মেঝভাই মহিবুর রহমান চৌধুরী। ১১ তারিখ তিনি বড় বোন ও তার তিন সন্তান ভাগনে ছালিক, মানিক ও ভাগিনী সাহেনাকে নিয়ে বাড়ী ফিরলেন তখন হীরা ও রুমীর জন্ম হয়নি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত সহজ ছিলনা পাবলিক বাস এবং লঞ্জের উপর নির্ভর করতে হত। মেঝভাই বড়আপা ও তার সন্তানদের নিয়ে লঞ্চ থেকে কুমারখাদা ঘাটে নামতেই আচমকা পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান এসে শেরপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালায়। তারা আশ্রয় নেন কুমারখাদা গ্রামের এক বাড়ীতে গছের নীচে। পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান চলে গেলে তারা কোনক্রমে বহু কষ্টে বাড়ি ফিরেন। তখন মায়ের কান্নাকাটি বন্ধ হয়, বললেন মরলে সকলে একসাথে মরব। এখন আর চিন্তা নেই।
পরদিন সকালে আমাদের বাড়ীর উত্তর দিকে মূলকপুর মাঠে আমাদের কামলারা জমিতে কাজ করছে আমি তাদের জন্যে ভাত নিয়ে মাঠে রোওয়ানা দিয়েছি। তখন সাকাল নয়টা মাথার উপর দিয়ে আবারও উড়ে আসল পাকিস্তানী জঙ্গি বিমান। হামলা শুরু করল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, আমিসহ মাঠের চাষীরা আশ্রয় নিলাম বানিপতা গ্রামে একটি গাছের নীচে। ওই সময় আমাদের পশ্চিমের বাড়ীর হুসিয়ার আলী একটি মোরগ হাতে যেতে চেয়েছিল তার মামার বাড়ী মঙ্গলপুর। হুশিয়ারকে দেখলাম কেঁদে কেঁদে ফিরছে। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে কাঁদচিস কেন সে বলল দাদা জঙ্গি বিমান একবারে আমার মাথর উপর এসেছে আমি ভাবছি আমার উপর পরে যাবে তাই কাঁদছি।
চট্রগ্রাম থেকে চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের বাড়ী ফেরা, আজও ফিরে আসা হয়নি তসলিমেরঃ
আগেই বলেছিলাম আমাদের চৌধুরী পরিবারের একটি বড় অংশ চাকুরী ও ব্যবসার সুবাদে তখন বসবাস করতের চট্রগ্রামে। ৭ই মার্চের পর থেকেই চট্রগ্রামে বিহারী বাঙ্গালী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। সকলেই বাড়ী ফেরার পরিকল্পনা করছিলেন, এখন তুলে ধরছি তারা কিভাবে চট্রগ্রাম থেকে ফিরলেন। সকলের ফেরা হলেও আজও ফেরা হয়নি তসলিমের।
ওই সময় চন্দ্রকোনা পেপার মিলের ফরেষ্ট ম্যানেজার ছিলেন আমাদের চাচাত ভাই আব্দুল মুকিত চৌধুরী (মাসুক ভাই সাহেব) | এছাড়া চাকুরী ও ব্যবসার সুবাদে আরো যারা চট্রগামে ছিলেন তারা হলেন ফারুকুর রশিদ চৌধুরী ফারুক ভাইসাহেব ও তার স্ত্রী সন্তান, তসলিম ও তার স্ত্রী-সন্তান, আতিকুর রশিদ চৌধুরী সমসাদ ভাই সাহেব তার স্ত্রী, রকিবুর রশিদ চৌধুরী মুরাদ ভাই সাহেব, হাছিনা আপা ও তার স্বামী, হারুনুর রশিদ চৌধুরী হারুন ভাইসাব। এছাড়া কামার গাঁয়ের আব্দুল গফুর ও তার পরিবার, মসিব পুরের আতিক উল্লাসহ আমাদের এলাকার আরো কয়েকটি পরিবার ।
যুদ্ধ শুরু হলে চট্রগ্রামে বসবাসরত সকলে সমবেত হন আব্দুল মুকিত চৌধুরীর বাসায়। পরিকল্পনা করেন নিরাপদ পথে বাড়ি ফেরার, ইতিমধ্যেই চট্রগ্রামে বিহারী-বাঙ্গলী দাঙ্গা শুরু হয়, বিহারী-বাঙ্গালী দাঙ্গায় শত শত মানুষ মারা যায়। বিহারীদের সাথে পাকিস্তানী সৈন্যরাও মাঠে। যেদিন সকলে একত্রিত হয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই মূহুর্থে হারুন ভাই সাহেব ছিলেন বাইরে। সকলে তার ফেরার অপেক্ষায় সিদ্ধান্ত হয় হারুন ভাই সাহেব ফিরলে সকলে রওয়ানা করবেন। এর ভেতর তসলিম বেরিয়ে পড়েন হারুন ভাই সাহেবকে খুঁজতে। হারুন ভাই সাহেব বাসায় ফিরলেও তসলিম আর ফিরতে পারেননি। তিনি বাসা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই পাক বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। একজন প্রতিবেশী জানালেন পাকবাহিনী তসলিমকে গুলি করে হত্যা করেছে। শুধু এটুকুই জানা যায়। আজপর্যন্ত তার লাশটিও পাওয়া যায়নি। দুদিন অপেক্ষার পর তসলিমের বউসহ সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতর দিয়ে শত শত মাইল পায়ে হেটে ২৪দিনে বাড়ি পৌঁছান। সকলে ফিরলেও তসলিমের আজও ফেরা হয়নি পাওয়া যায়নি লাশটিও।
১৩ এপিল পাকিস্তান বাহিনী আবারও শেরপুর দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী সরে গেলে পাকিস্তানীরা ঘাটি গেরে বসে শেরপুরে
শেরপুর ও আশপাশ এলাকার মানুষ বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। বিশেষ করে শেরপুর থেকে সাদিপুর পর্যন্ত বড় সড়কের উভয় পাশের মানুষজন গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। জনশূন্য গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয় হানাদার পাক সেনারা। শেরপুরে থেকে সাদিপুর পর্যন্ত সিলেট মৌলভীবাজার সড়কের উভয় পাশে দুইমাইলের ভেতর একটি বাড়িও অবশিষ্ট নেই, সব পাকিস্তানী সৈন্যরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন বরবর পাকিস্তানা সৈন্যরা শেরপুর থেকে চারিদিকের গ্রাম গুলোতে হানা দেয়া শুরু করে। আমাদের গ্রামের লোকজন প্রতিদিন চেয়ে থাকতো পূর্বদিকে আমরাও অনেক দিন ভয়ে পালিয়েছি। কেউ জোরে চিৎকার দিয়ে বলতো পাইনজাবী আইছে এই কথা শুনলেই মানুষ পূর্ব থেকে পশ্চিমে দৌড়াতো। এপ্রিলের ১৭ বা ১৮ তারিখ হবে সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই, শেরপুর ক্যাম্প থেকে চার/পাঁচজন হানাদার আসলো কুমারখাদা গ্রামে। গ্রামের মানুষজন পালিয়েছে কুশিয়ারা নদীর উত্তরপার তাজপুর গ্রাম থেকে কুমারখাদা এসে আশ্রয় নিয়েছিল হারাধন নমসুদ্রের পরিবার তারা পালাতে পারেনি ভয়ে গ্রামে একটি জঙ্গলে প্রাণ বাঁচাতে লুকিয়ে ছিল হারাধন এবং তার স্ত্রী, পাকবাহিনী ওই দম্পতিকে গুলি করে হত্যা করে। এর পর প্রায়ই গ্রামগুলোতে হানা দিত পাকিস্তানী সৈন্যরা। তখন দুর্গাপুর গ্রামের ইদুমুন্সি এবং আহমদপুর গ্রামের কমলা মুচি ভাল উর্দু জানতেন, পাকসেনারা আসলে সকলেই এই দুজনের শরনাপন্ন হতেন। তারা পাকিস্তানীদের উর্দুতে বুঝিয়ে দিতেন। তখন কিছুটা পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার কমলেও হানা দেয়া বাদ দেয়নি। গ্রামগুলোতে ঢুকে হাস মূরগি ছাগল ইত্যাদি নিয়ে যেত নাগালে পাইলে মহিলাদের ধর্ষণ করত।

বুরুঙ্গা ও আদিত্যপুরে গণহত্যাঃ
তারিখটা আমার সঠিক মনে নেই, ওসমানী নগরের বুরুঙ্গার পার্শবর্তি মামনপুর গ্রাম থেকে আমাদের এক মামা (আমার বড় চাচীর ভাই) সৈয়দ ময়না মিয়া কোন ক্রমে ঘুরে ঘূরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন, তার কাছ থেকে জানা গেল বুরুঙ্গার গণহত্যার ঘটনা। তখনও শান্তি কমিটি গঠন করেনি পাকিস্তানীরা, স্থানীয় কয়েকজন দালাল আগেই পাকিস্তানীদের সাথে হাত মেলায়। এদের অন্যতম ছিল ওসমানী নগরের করনসীর সাদ, (আব্দুল আহাদ চৌধুরী) তার নাম আব্দুল আহাদ চৌধুরী হলেও এলাকায় সাদ নামে পরিচিত ছিল। হাজিপুরের তিনফুটি ডাক্তার, গহরপুরের মোহাদ্দিস (এই মোহাদ্দিস হলো মৌলানা নূর উদ্দিন), এই নূরউদ্দিন সত্তরের নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীর সাথে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম থেকে খেজুরগাছ প্রতিক নিয়ে এবং আরো কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে পরাজিত হয়েছিল। এদের অন্যতম শেরপুরের কালামলানা (মৌলানা আবু সাইদ) এই কালা মলানা নিজের ব্যবসা বানিজ্যের কারণে শেরপুরে অবস্থান করলেও শান্তি কমিটির সদস্য হয়নি বা কাউকে হত্যায় সহযোগীতা করেননি, পরলে অনেককে বাঁচিয়েছেন। সাদের নেতৃত্বে স্থানীয় দালালরা পাকিস্তান বাহিনীকে ডেকে আনে বুরুঙ্গা এলাকায় স্থানীয় হিন্দুদের নিয়ে জড় করে বুরুঙ্গা হাইস্কুলে। সেখানে পাকিস্তানীরা প্রায় দেড়শ জন হিন্দু মানুষকে হত্যা করে। এর কয়েকদিন পর বুরুঙ্গার অদূরে আদিত্যপুরে একই কায়দায় গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী।
গোয়ালা বাজার থেকে ধরে এনে ৯জনকে সাদিরপুরে হত্যাঃ
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকবাহিনীর কারফিউ কিছুটা শিথিল হয়েছে। মানুষজন ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে, (তারিখটা মনে নেই) গোয়ালাবাজার এলাকায় দালাল সাদ ৮জন হিন্দুকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এই আটজনের মধ্যে একজন ছিল স্থানীয়, সে সাদের কাছে মিনতি করে বলছিল অমার বাচ্চাদের অন্যের বাড়ীতে রেখে এসেছি, সারাদিন কিছু খায়নি, আমার শিশু বাচ্চাটা কিছু খায়নি তার জন্যে কলা কিনেছি, আমি কলাগুলো দিয়ে আসলে আপনি মিলিটারীর হাতে আমাকে তুলে দিন। কে শোনে কার কথা, ওই ভদ্রলোকের কলাগুলো দালাল সাদ হাসতে হাসতে খেয়ে নিল। ঠিক এই সময় শ্রীরামসীর রবি তার বোনকে নিয়ে বাড়ী ফিরছিল তার পরনে ধুতি দেখেই বলল এই শালা মালাউন ওকে ধর। তার বোন কোন ক্রমে ১০মাইল হেটে গোয়ালবাজার থেকে বাড়ী ফিরল। রবিসহ এই নয়জনকে সাদিপুরে এনে লাইন ধরে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী। এর তিনদিন পর আমাদের ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের পুরাতন কুশিয়ারা নদীতে এদের লাশ ভেসে উঠল। আমরা লাশ দেখেছি। রবিকে আমি চিনতাম তার লাশ সনাক্ত করতে পারছিলাম।
হলদারপুরে বিয়ে বাড়ীতে পাকিস্তানীদের বিমান হামলাঃ
বানিয়াচং উপজেলার হাওর বেষ্টিত ছোট একটি গ্রাম হলদারপুর। তারিখটা আমার মনে নেই বাংলা বৈশাখ মাস, দুপুর বেলা হঠাৎ শুনতে পেলাম জঙ্গি বিমানের আওয়াজ। একসাথে তিনিটি বিমান ওই গ্রামে আক্রমন চালায়। তাদের ধারণা ছিল এটা হয়তো কর্ণেল রব সাহেবের বাড়ী, আসলে রব সাহেবের বাড়ী খাগাউরা গ্রামে। পাকিস্তানীরা মনে করছে এখানে মুক্তিবাহিনী জড় হচ্ছে। এই কর্ণেল রব ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সহ চীফষ্টাফ। তিনি ৭০এর নির্বাচনে নবীগঞ্জ-বাহুবল ও আজমিরিগঞ্জ থেকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। পাকিস্তানীদের এই হামলায় অনেক লোক আহত হলেন, নিহত হয়েছেন অনেক। আমাদের গ্রামের প্রাইরামী স্কুলের কাছে ছিল একটি বাঁশ ঝাড়, এখন এই বাঁশঝাড়ের অস্থিত্ব নেই, এখন হয়েছে নতুন রাস্তা। এখান থেকে অর্থাৎ বাঁশ ঝাড়ের পাশে দাড়িয়ে বিমান আক্রমন প্রত্যক্ষ করছিলাম আমরা কয়েকজন। আমরা যখন সকলে জড় হয়ে আক্রান প্রত্যক্ষ করছি আমার শ্রদ্ধেয় চাচা ডাঃ আলী আসগর নূরী চৌধুরী সাহেব সকলকে খোলা স্থানে না-দাড়িয়ে বাশঝাড়ের নীচে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, তার নির্দেশে আমরা ঝোপের ভেতর থেকে হলদারপুরের বিমান হামলা প্রত্যক্ষ করলাম। তিনি বলনের এভাবে দাড়ানো ঠিক নয় আমাদের উপর হামলা হতে পারে। দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা থেকে ১৯৭৫ সালে ট্রেনে বাড়ী ফেরার সময় একটি পরিবার পেলাম তারাও ঢাকা থেকে সায়েস্তাগঞ্জ আসছেন। এই পরিবার হামলার শিকার হয়েছিলেন দেখলাম ৫/৬ বছরের একটি মেয়ে শিশু তার পায়ে সেলের আঘাত লেগেছে, এই আঘাতের চিহ্ন কোন দিন মুছবেনা। তারা জানালেন ওই বাড়ীতে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। পাকিস্তানী বিমান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প মনে করে আক্রমন চালিয়েছিল বিয়ে বাড়িতে।
আমাদের বাড়ীতে পাকবাহিনীর হানাঃ
এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের প্রথম হবে। পূর্ব দিক থেকে কয়েকটি গ্রাম ও আমাদের গ্রামের মানুষজন এসে আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিল নারী পুরুষ শিশু মিলিয়ে হাজার খানেক হবে। আমরা তখন পূরাতন বাড়ীতে এই বাড়িটি বেশ লম্বা হাটিবান্দা বাড়ি। সকলের ভরষা এই বাড়ীতে পাঞ্জাবী কিছু করবেনা। শেখ সাহেব আছেন হয়তো উনাকে সম্মান করবে। শেখ সাহেব বলতে আমার বাবার চাচাত ভাই ডাঃ আলী আসগর নূরী চৌধুরী। একসময় সরকারী চাকুরী করতেন পরে চাকুরী ছেড়ে কংগ্রেসর রাজনীতি করেছেন, ছিলেন অখন্ড ভারতের পক্ষে। দেশ বিভাগের পর রাজনীতি ছেড়ে নিযেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত করেন। আমাদের এলাকা সহ দূরদূরান্তের লোকজন তার কাছ থেকে দোয়া তাবিজ কবজ পানিপড়া নিত। সকলে তাকে সম্মান করত। বাড়ী থেকে বের হতেনা। আমাদের পূরাতন বাড়িটি ছিল তিন পট্টির, প্রথম ধাপে আমাদের বাংলা ঘর গুলো এর পরের সাড়িতে গোয়াল ঘর, এরপরে অন্দর মহল।
গ্রামের আগত মানুষদের শেখ সাহেব ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি চেয়ার নিয়ে বাংলোর সামনে বসে রইলেন। আমার মেঝ ভাই মহিবুর রহমান চৌধুরী নিজে তৈরী করে স্বাধীন বাংলার পতাকা টানিয়ে ছিলেন বাড়ীতে। পাকিস্তানীদের ভয়ে পতাকা নামিয়ে দিল সকলে। ভয়ে আমরা কেই কোন প্রতিবাদ করিনি। সকাল সাড়ে আটটা নয়টার দিকে ত্রিশ পয়তিশ জনের পাক সেনার একটি দল ঢুকে পড়ল আমাদের বাড়ীতে, শেখ সাহেব তাদের বসতে দিলেন বাংলায়। এরা চতুর, বাংলোর ভেতরে না বসে বসল বাইরে। গ্রামের যারা বয়স্ক ছিলেন সকলে তাদের বসতে দিলেন নারী/শিশু এবং যুবক যারা ছিলেন সকলেই ভেতর বাড়ীতে অবস্থান নিলেন। এদের আপ্যায়ন করা হল চা বিস্কুট দিয়ে। এর ভেতর ঘটে গেল আরেক কান্ড, আমাদের পশ্চিমের বাড়ীর তাহির উল্লা ভাইর ঘরে প্রবেশ করল দুই পাক সেনা, তারাও ভয়ে আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘরে লোকজন না দেখে বেরিয়ে আসল, এর ভেতর তাদের ঘর তন্ন তন্ম করে দেখল মূল্যবান কিছু পাওয়া যায়কিনা। বিছানার নীচে ছিল পাঁচ টাকা ওই টাকা গুলি নিয়ে গেল হানাদারা তখনকার সময়ের পাঁচ টাকা অনেক মূল্যবান। আমাদের উত্তরের বাড়ীর লোকজনও আমাদের বাড়ীতে। উত্তরের বাড়ীর সমছু ভাতিজা দেখলাম নিজে চুলোয় কাঠালের বিচি কুলায় ভাজছেন, জিজ্ঞেশ করলাম তুমার ভয় নাই? তার সোজা উত্তর মা চলে গেছেন তুমাদের বাড়ীতে এই সুযোগে কাটাল বিচি খাইছি, পরে মা খেতে দিবেননা। সবাই যখন ভয়ে দিক বিদিক ছুটাছুটি করছে এই সময় সমছু ভাতিজার কাঠাল বিচি খাওয়া দেখে হাঁসছিলাম। আমাদের বাড়ী থেকে বের হয়ে পাকসেনারা কামারগাও ঘুরে ছৈদপুর হয়ে আবার শেরপুর ক্যাম্পে ফিরে গেল। যাবার সময় রায়ঘর গ্রাম থেকে কয়েকটি ছাগল ধরে নিয়ে গেল। যাবার পথে জিয়াপুর গ্রামের দু‘ব্যক্তিকে ডেকে এনে বললো চলো আমাদের সাথে, এরা উভয়েই ছিলেন বয়স্ক, শেষ পর্যন্ত এদের প্রহার করে ছেড় দিল।
বিধু বাবুর বাড়ীতে পুলিশী অভিযান ও এলাকার শতাধিক যুবক নিয়ে বাবুর মুক্তিবাহিনীতে যোগদানঃ
তারিখটা আমার সঠিক মনে নেই, মে মাসের শেষ অথবা জুন মাসের প্রথম দিকের ঘটনা, নবীগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি গুজাখাইর গ্রামের বাসিন্দা জমিদার শ্যামা প্রসন্ন দাস গুপ্ত (ডাক নাম বিধুবাবু) চিরকুমার এই জমিদার ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। সর্বসাধারনের কাছে তিনি ডাক নাম বিধুবাবু হিসেবেই ছিলেন অধিক পরিচিত। তখনও রাজাকার বাহিনী পুরোপুরি গঠিত হয়নি, পুরো দেশ পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে এলাকার দালালরা শান্তিকমিটি গঠনে সক্রিয় হয়ে উঠছে, স্থানীয় দালালদের নিয়ন্ত্রনে থানা সহ প্রশাসন। এর ভেতর স্থানীয় দুজন দালাল ইসমাইল মৌলানা ও আব্দুর রহমানের নির্দেশে নবীগঞ্জ থানা থেকে তিনজন পুলিশ সদস্য বাবুকে এরেষ্ট করতে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির। পুলিশ বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে বলল বাবু আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছ, আপনি দুস্কৃতকারী মানে মুক্তিবাহিনীকে আপনার বাড়ীতে আশ্রয় দেন। আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। হবিগঞ্জ ও শেরপুর ক্যাম্প থেকে নির্দেশ এসেছে আপনাকে নিয়ে যেতে। আসলে পুলিশ পাঠিয়ে ছিল ওই গ্রামের এক পাকিস্তানী দালাল পরবর্তিতে শান্তিকমিটির নেতা আব্দুর রহমান ও জামাত নেতা নবীগঞ্জের গণহত্যার নায়ক মৌলানা ইসমাইল। বাবু বললেন আপনারা খাওয়া দাওয়া করুন, আমাকে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেবেন, আমি খেয়ে নেই আমার বাড়ীর যা আছে তা গ্রামবাসিকে বিলিয়ে দেই। সম্পদ বলতে ধান চাল গ্রামের মানুষকে বিলিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীর সাথে শেষ দেখা করে নিই, এর পর নিয়ে যাবেন। বাবু এলাকার যুবকদের মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুত হয়ে তার বাড়ীতে আসার জন্য গোপনে লোক পাঠান, এর আগ থেকেই বাবু মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। দালাল আব্দুর রহমান জেনেই পুলিশ পাঠায় তার বাড়িতে। এর ভেতের চারিদিক থেকে মানুষ জড়ো হলেন বাবু আদেশ করলেন আমার ভাড়ারে ধান আছে কম হলেও পাঁচ হাজার মন, সব আপনারা নিয়ে যান, গ্রামের মানুষ বাবুর বাড়ীর মালামালও ধান চাল যে যা পারে নিয়ে গেল। এর ভেতর চার পাঁচটা নৌকা নিয়ে এলাকার প্রায় দেড়শতাধিক যুবক আসলেন বাবুর বাড়ীতে। সবাই বললেন আমরা তৈরী হয়ে এসেছি আপনি আদেশ করুন। এর আগেই কয়েকজন মিলে পুলিশদের বেঁধে রাখছিলেন আর কেউ কেউ নজর রাখছিলেন শেরপুর বা হবিগঞ্জ থেকে পাঞ্জাবী আসেছে কিনা। সকলে তৈরী হয়েই আসছিলেন। যুবকদের নিয়ে বাবু রোওয়ানা করলেন যুদ্ধে। পুলিশকে রেখে গেলেন গ্রামবাসীর জিম্মায়। তিনি বাড়ী থেকে বের হওয়ার পরপরেই ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসি ওইপুলিশ সদস্যদর হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। এর পর ৩/৪ দিন পর পাকিস্তানী সৈন্যরা ইসমাইল মৌলানার নির্দেশে এই গ্রাম ও আস-পাশের গ্রাম গুলোরে সকল হিন্দু বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। হামলা হয় কয়েকটি মুসলমান বাড়িতেও। বাবু ছিলেন চির কুমার, আমাকে খুবই স্নেহ করতেন নবীগঞ্জে গেলে থাকতাম তার বাসায়। স্বাধীনতার পর তার কাছ থেক এসব জানার চেষ্টা করেছি তিনি বলতেন সময় আছে বলব। আর সব কিছু বলা হয়নি বাবুও দেশ ছেড়ে চলে যান। এখন আর ইহজগতে নেই। বাবুর সাথে সেদিন যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে বাড়ি ছেড়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আমার ভগ্নিপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল সিদ্দিকী ও তার ছোট ভাই সহ গুজাখাইর, উমরপুর, গয়াহরি সহ আশপাশ গ্রামের প্রায় দেড় শকাধিক যুবক।
এলাকায় রাজাকার ক্যাম্পঃ
যুদ্ধের মাঝামাঝি জুন/ জুলাই মাস থেকে আমাদের এলাকার মানুষজনকে নতুন করে আরেক উৎপাতের মোকাবেলায় পড়তে হয়। এই উৎপাতের নাম রাজাকার আতংক। স্থানীয় সৈয়দপুর বাজরে (বাজারসৈদপুর) প্রতিষ্ঠিত হয় রাজাকার ক্যাম্প। এর দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা সৈয়দ সঞ্জব আলী চেয়ারম্যান। তিনি এতই প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন যে তার কথার কোন প্রতিবাদ কেউ করতো না। তার নির্দেশে এলাকার সাবেক মেম্বার চেয়ারম্যান ও প্রভাবশারীদের বাধ্য হয়েই শান্তি কমিটিতে নাম লিখাতে হলো। নির্দেশ অমান্য করলে মৃত্যু, তাই কেউ প্রতিবাদ নাকরেই শান্তি কমিটিতে নাম লেখান। যারা শান্তি কমিমিটিতে নাম লিখিয়েছিলেন অধিকাংশই আওয়ামীলীগার। এই শান্তি কমিটির নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও রাতের আঁধারে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। সৈয়দ সঞ্জব আলী উমরপুর/ পিঠুয়া মংলাপুর সহ (আউশকান্দি-দীগলবাক) দুই ইউনিয়নের গরীব নিরীহ কয়েক জনকে জোর করে রাজাকর বাহিনীতে যেতে বাধ্য করেন। এসময় তাঁর চাঁপে যারা শান্তি কমিটি ও রাজার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন উমরপুর গ্রামের বাতির আলী, মনোহর আলী, পিঠুয়ার মাহমুদ চৌধুরী, নূরগাঁও গ্রামের আবুল ফজল চৌধুরী, বাড়িঘাঁও এর আব্দিুর রহমান সহ আরো কয়েকজন। যারা শান্তি কমিটির নেতা হয়েছিলেন লামাজিয়াপুর গ্রামের হাজি গোলজার আলী (ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি), বোয়ালজোর গ্রামের তাহির উদ্দিন মেম্বার, নূরগাঁয়ের সফিকুল হক চৌধুরী, মর্তুজা আহমদ চৌধরী, আব্দুর রশিদ চৌধুরী, চৈতন্য পুরের সুন্দর খান, উরপুরের সৈয়দ শাহাদত আলী, কসবার লিপাই চেয়ারম্যান, পারকুল বনগাঁও গ্রামর জাহির উল্লা মেম্বার, মিনাজ পুরের ডাক্তার সাহেব প্রমুখ। এদের সকলকেই রাজাকার ও শান্তি কমিটিতে নাম লিখাতে বাধ্য করা হয়। এককথায় পরিস্তিতির শিকার। এদের ছাড়া অন্য যারা এই এলাকার রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্য হয়েছিলেন সকলেই স্বেচ্ছায় বা পেয়ারে পাকিস্তানের প্রতি আনুগ্য প্রকাশ করে।
সম্রাটঃ এখানে আরেক ভদ্র লোকের নাম না বললেই নয়, তার নাম পিঠুয়ার মনির বেজ। এই মনির বেজ তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল শেরপুর ক্যাম্পোর এক পাকিস্তানী মেজরের সাথে। এই সময় এই মনির বেজ হয়ে উঠে এই এলাকার অলিখিত একজন সম্রাট। এলাকার শান্তি কমিটির সদস্য সহ রাজাকারদের সকলেই তার নির্দেশ মানতে বাধ্য। কেনানা মনির বেজ মেজরের শ্বশুর।
রাজাকারের চাঁদাঃ এলাকার সকল মানুষকে রাজারকদের খাবোরের কথা বলে সৈয়দ সঞ্জব আলী প্রতি মাসে এলাকার মানুষকে রাজাকারদের চাঁদা দিতে বাধ্য করেন। রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রতিটি বাড়ি থেকে নগদ টাকা চাল, হাস, মুরগি নিয়ে আসতো। আমাদেরকেও বাধ্যতামূলক রাজাকারের চাঁদা দিতে হয়েছে। প্রবাসী পরিবার হলেতো উপায় নেই, প্রবাসী পরিবারগুলোর উপর চাঁদার পরিমান ছিল বেশী। এই ক্যাম্পর রাজাকাররা প্রতিাদিন বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষদের অত্যাচার করত। বিশেষ করে হিন্দু পরিবারগুলো বেশী অত্যাচারিত হয়। চোর-ডাকাত দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে এলাকার মানুষদের ক্যাম্পে ধরে আনতো, অনেককেই এরা নিজেরা কোর্ট বসিয়ে গুলি করে হত্যার হুকুম দিত। কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দিত শেরপুর পাঞ্জাবী ক্যাম্পে। ঠিক এই ভাবে হোসেনপুর গ্রামের অশ্বিনী কুমার নাথকে চোর আখ্যা দিয়ে মিনাজুরের পুলে নিয়ে রাজাকারা গুলি করে হত্যা করে। আমার পরিস্কার মনে আছে এই সঞ্জব আলী আমাদের বাড়ীতে এসে বললেন অশ্বিনীকে গুলির অর্ডার দিয়েছি। কাল তাকে মিনাজপুরের পুলে নিয়ে গুলি করা হবে। (চলবে)