যুদ্ধাহত মহিউদ্দিন চৌধুরী
বরবর পাক বাহিনী ১৯৭১ সালের ১সেপ্টেম্বর রাণীগঞ্জ বাজারের চালায় নৃশংস হত্যা কান্ড। বাজারের ১৫১জন ব্যবসায়ীকে হত্যা করে। আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে দেয় রাণীগঞ্জ বাজার, এতে অলৌকিক ভাবে প্রাণে বেঁচে যান আমাদের চাচাত ভাই মহিউদ্দিন চৌধুরী (আলখাছ মিয়া)। রাইফেলের গুলি থেকে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাঁকে। গুলিতে তার ডান হাত সম্পুর্ণ নষ্ট হয়ে যায়।
পাকিস্তানীরা তাঁকে মৃত ভেবে চলে গেলে নারিকেল তলার (অবঃ) সুবেদার ও রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন তাকে উদ্ধার করে তার বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখান থেকে পর দিন তাঁকে বাড়ীতে আনা হয়। দেশে যুদ্ধ চলছে চিকিৎসা সুবিধা নেই হাসপাতালেও ভর্তি করার উপায় নেই। যুদ্ধকালীন সময় বরিশালের একজন ডাক্তারকে মৌলভীবাজার থেকে আমার চাচাত ভাই আব্দুল মুকসিত চৌধুরী (আনহার) বাড়ীতে এনে আশ্রয় দিয়েছিলেন এই ডাক্তার যুদ্ধের কারণে বরিশাল ফিরতে পারছিলেননা। তার সাথে ছিল ওষুধপাতি এবং চিকিৎসা সামগ্রী। এই ডাক্তারের চিকিৎসাতেই তিনি সেরে উঠেন। দেশ স্বাধীনের পর উন্নত চিকিৎসা নিলেও আর কাজ হয়নি।
নিযার্তনের শিকার ছমির ভাইঃ
কামারগাঁও লামাজিয়াপুর গ্রামের ছমির ভাই ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে কামারগাঁও থেকে বাড়ী কিনে পুরাদিয়ার আসেন। ১৯৭১ সালে তিনি পুরাদিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। ছরিম ভাই দেখতে খুব হ্যন্ডসাম ছিলেন। তিনি পর পর দুদিন পাকিস্তান বাহিনীর নির্জাতনের শিকার হন। প্রথমদিন তিনি গিয়ে ছিলেন আলমপুর ফেরার পথে পাক বাহিনী তাকে পিটুয়া গ্রাম থেকে ধরে নেয়। তখন নির্যাতন করে। এর পর দ্বিতীয় দফা পারকুল গিয়েছিলেন সেখানে পাকিস্তানী ও রাজাকাররা এসে হাজির। প্রথমতো মারধর করলো বলল তুম… শালা মালাউন… হে। তুম মুসলমান নিহি-হে ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন রাজাকারও সাক্ষি দিল তিনি মুক্তিবাহিনী নন হিন্দুও নয়। তার পরেও পকিস্তানীরা বিশ্বস করতে নারাজ। তাকে লুঙ্গি খুলে সবার সামনে পরিক্ষা করল তিনি মুসলিম না হিন্দু। শুধু ছমির ভাইই নন এভাবে অনেককে পাকস্তানীরা এভাবে উলঙ্গ করে দেখত।
মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসলেন মেঝভাইঃ
জুলাইর পর থেকে সামান্য সামান্য গাড়ি চলাচল করতে শুরু করেছে। কেউ বের হতে হলে বা সিলেট যেতে হলে স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্প থেকে ডান্ডি কার্ড বা পাস নিতে হত। আমার মেঝভাই মহিবুর রহমান চৌধুরী মায়ের ওষুধের জন্যে পাস নিয়ে সিলেট গেলেন। ফেরার পথে সাদিপুর আসতেই তিনি সহ আরো দুজনকে আটক করল পাকিস্তানীরা। চাইলো হত্যা করতে। হত্যার উদ্দেশ্যে নদীতে নামালো যখন পাকিস্তানীরা তাদের গুলি করতে উদ্যত হচ্ছে, ঠিক এই মূহুর্থে কালামৌলানা এসে হাজির হত্যার প্রস্তুতি দেখে দূর থেকে চিৎকার করে বললেন টের। পাকিস্তানীরা থামলে তিনি পাকিস্তানীদের বলে কয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এই মূহুর্থে কালা মৌলানা না আসলে পাকবাহিনী তাদের হত্যা করতো এর পর আর কোনদিন বাড়ী থেকে বের হননি।
ভাবীর মৃত্যুঃ
অক্টোবর মাসের শেষ দিকে আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন তার বাবার বাড়ী দক্ষিন সুরমা উপজেলার ঝাঝর গ্রামে কলেরা রোগে হটাৎ করেই মারা যান। কয়েকদিন পূর্বে আমাদের বাড়ী থেকে নৌকা করে বিশ্বনাথ ঘুরে দক্ষিন সুরমা উপজেলার ঝাঝর গ্রামে যান। বড়ভাই খলিলুর রহমান চৌধুরী তখন ছিলেন তার শ্বশুর বাড়ীতে। ঝাজর থেকে একজন লোক খবর নিয়ে আসে আমাদের বাড়ীতে। বাবা যাবার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো তার ডান্ডি কার্ড নেই। সৈয়দপুর ক্যাম্প থেকে রাজাকারদের ১০০ টাকার বিনিয়ে ডান্ডি কার্ড নিয়ে গেলেন লাশ দাফনে। ফেরার সময় পাকিস্তানীরা আমার বাবাকে নির্জাতন কেরেছে। শেষ পরজন্ত কোন ক্রমে বাড়ি ফেরেন। তারাও চেয়েছিল তাঁকে হত্যা করত, একজন স্থানীয় রাজাকার তাঁকে রক্ষা করে।
স্মৃতির পাতা থেকে নয় মাসঃ
প্রথম যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন দেশের মানুষ ছিল কিংকর্তব্য বিমুঢ় কি করতে হবে বুঝে উঠতে পারেনি। তার পরেও মানুষের শেষ সম্বল বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণী “যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রুখে দাড়াও শত্রুর মোকাবেলা কর” মানুষ তাই করেছে। দেশে শুরু হল প্রতিরোধ যুদ্ধ, প্রথমে পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও তাদের সাথে ছাত্র কৃষক-শ্রমিক সকলে। দেশ যখন পুরোটাই পাক বাহিনীর দখলে চলে গেল, ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী মুজিব নগর সরকার গঠিত হল। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা আক্রমন শুরু করল। তখন মানুষের মনে একটা সাহস তৈরী হয়। সবাই বুঝতে পারল দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস আমাকে গ্রামের বাড়ীতে কাটাতে হয়েছে। তখন স্কুল কলেজ বন্ধ, প্রতিদিনই খবর আসে ওই গ্রামে পাক বাহিনী আক্রমন করেছে, ওই গ্রামে গণহত্যা করেছে পাক বাহিনী। মানুষজনও সকলে ভারতে যেতে পারেনি যখন যে অঞ্চল নিরাপদ সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে।
চেনা নেই জানা নেই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একে অন্যক আশ্রয় দিয়েছে। আমাদেরও কয়েকবার বাড়ী ছেড়ে পালাতে হয়েছে আবার ফিরে আসতে হয়েছে। তখন প্রতিদিনই বর্ডার এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতাম, বা খবর আসছে নদী দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছে। অনেক লাশ নদীতে ভাসতে নিজে দেখেছি। এমনকি মানুষ বড় মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল প্রায়ই মাছের ভেতর মানুষের আঙ্গল পাওয়া যেত। আমাদের গ্রামের গোলাম মস্তফা চৌধুরী কুচা দিয়ে বড় একটি বোয়াল শিকার করেছেন মাছ কাটতেই মাছের ভেতর দেখা গেল মানুষের হাত। শত শত মানুষের লাশ নদীতে ভাসতে ভাসতে পঁচে গিয়েছে। তার হিসেব কেউ রাখেনি।
তখন একমাত্র ভরষা রেডিও ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, আকাশবাণী কলকাতা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। গ্রামের সব মানুষ আমাদের বাড়ীতে আসতেন রেডিও শুনতে। তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরের পাশাপাশি দুটি প্রোগ্রম ছিল জনপ্রিয়। একটি চরমপত্র অন্যটি বজ্রকণ্ঠ, বজ্রকণ্ঠ মানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। প্রতিদিন এই ভাষণটি বাজানোর কারণ ছিল মানুষের মনবল চাঙ্গা রাখা। এসময় প্রাই লোকমুখে খবর আসতো কোথায় কোনদিন গণহত্যা হয়েছে এভাবে আমরা জানতে পারি মৌলভবিাজারের নরিয়া ও বানিয়াচঙ্গের ঝিলুয়া মাখাল কান্দির গণতহ্যার খবর।
এই সময় আমি একটি শালিক পোষেছিলাম শালিকটা অল্প দিনের ভেতর পোষ মানে আমি যে দিকে দৌড়াতাম শালিকও আমার সাথে সাথে থাকতো। মাঠ থেকে ঘাসফরিং ধরে আনতান তখন আমার ভাগিনি সাহেনা মাত্র ছয় মাস বয়স সে পাখিটিকে ফরিং খাওয়াতো। ওই সময় আমাদের বিনোদন বলতে কিছুই ছিলনা আমাদের ছিল একটি মাখড়া রংগের ষাঁড়, আমাদের পূবের বাড়ীর মানিকদের একটি লাল রংগের ষাঁড়, আশিক মিয়াদের একটি সাদা রংগের ষাঁড় শ্রীধরপুর হাজীবাড়ীর দুটি একটি লাল অন্যটি মাখড়া রংগের প্রতিদিন ওই ষাঁড় দিয়ে গ্রামে ষাঁড়ের লড়াই হতো। একদিন শ্রীধরপুরের মাঠে হচ্ছে ষাঁড়ের লড়াই ঠিক মূহুর্থে দেখলাম নারী পুরুষ শিশু সহ লোকজন দৌড়ে আসছে কে বলছে “পাইঞ্জাবী আইছে” এই কথা শুনা মাত্র ষাঁড়গুলো মাঠে রেখে যে যেভাবে পাড়ি দৌড়ালাম। শেষে দেখা গেল দুর্গাপুর থেকে পাক-হানাদাররা খাশি মোরগ ইত্যাদি সহ কয়েকটি বাড়ী লুট করে আবার শেরপুর ফিরে গেছে।
এখানে একটি কথা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন। তখন যে বাচ্চার জবান ফুটেছে সে বলতো জয়বাংলা। জয়বাংলা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মানুষকে পাক বাহিনী লাইন ধরে গুলি করেছে মানুষজন নিজ নিজ ধর্ম মতে প্রথমে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়েছে এর পর জয় বাংলা বলে বুক পেতে গুলি নিয়েছে।
দেশের সব মানুষের পক্ষে ভারতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যারা শহরে ছিল তারা গেরিলাদের নিজেদের বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছে। ঠিক গ্রামাঞ্চলেও মানূষজন প্রতিটি বাড়ীতে মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং সহযোগীতা করেছে। যার বাড়ীতে রাতে গেরিলা যোদ্ধারা আসতো, নিজে না খেয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদর খাইয়ে দিত। চিহ্নিত রাজাকার ছাড়া দেশের সকল নারী-পুরুষ এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছে।
আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই রাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা আসতো নৌকায় করে তখন রাতে মোরগ ধরে জাবই করে রান্না করে খাইয়ে দেয়া হত। যাতে মোরগ না ডাকে সেজন্য প্রথমে গলা টিপে ধরা হত। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই দেশের অভ্যন্তরে ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিত। খবর আসতো এখানে ওখানে পুল ব্রিজ মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মাছ বিক্রেতা নৌকার মাঝি, চাষি সেজে পাক বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমন করে প্রায়ই দুশমনদের হত্যা করতো। তখন প্রায়ই বয়স্কদের কাছ থেকে শুনতান পাকস্তানীরা সাতার জানেনা বর্ষা আসলে এদের মারতে সহজ হবে। যখন বর্ষা আসল দেখা গেল পাকিস্তানীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নৌকা এবং স্প্রিট বোট দিয়ে গ্রাম চলে আসে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে অনেক মুক্তিযুদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি দেখেনি শুধু তার কথা শুনে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কেননা তখন গ্রামে কোন টিভি ছিলনা রেডিও ছিল একমাত্র ভরসা। যারা সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল অীধকাংশই গ্রামের কৃষক-দিনমজুর ছাত্র জনতা। তখন রাতে আমাদের নিয়মিত রুটিন ছিল আকাশ বাণী কলকাতা-ভয়েস অব আমেরিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রতিরাতে মানুষের মনবল ঠিক রাখতে বজ্রকণ্ঠ নামে বঙ্গবন্ধুর ৭তারিখের ভাষণ বাজানো হতো। সেই আরেকটি পোগ্রাম ছিল চরমপত্র। সেই সাথে দেশাত্মবোধক গান আমরা কজন নবীন মাঝি, শুন শুন লোকে বলে শুন যত খাটি আমার বাংলাদেশের মাটি, জয় বাংলা বাংলার জয় ইত্যাদি গান। সেই প্রচার করা হত কোথায় পাকসেনারা অক্রমন করেছে কোথায় মুক্তিবাহিনী শত্রুদের হত্যা করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
জুনের পর থেকে আমাদের এলাকা সহ সমগ্র দেশে শুরু হলো রাজাকারদের অত্যাচার। আমাদের এলাকায় রাজাকারদের ঘাটি ছিল সৈয়দপুর বাজারে (বাজার সৈদপুর)। রাজাকাররা এসে এলাকার প্রতিটি বাড়ীতে নিয়মিত চাঁদা নিত চাঁদা না দিয়ে অত্যাচার করতো। সেই সাথে এই গ্রামে ওই গ্রামে নিয়মিত হান দিত। এভাবে যুদ্ধের নয়মাস রাজাকার ও পাক বাহিনীর অত্যাচার নিপিড়ন সহ্য করতে হয়েছে আমাদের।
রাজাকাররা বাউশা নাদামপুর গ্রামে এবং দিনারপুর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এটি ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। আজ এই গ্রাম কাল আরেক গ্রামে রাজাকারা হানা দিয়েছে। আমাদের এলাকায় রাজাকারা ইনাতগঞ্জ বাজার লুট সহ গুলডোবা গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি পুড়িয়ে দিল। এসব পাকিস্তানী সৈন্যরা করেনি করেছে দেশীয় রাজাকার বাহিনী।
এভাবে সৈয়দপুর ক্যাম্পের রাজাকাররা হুসেন পুরের অশ্বিনী নাথ, বোয়ালজোর গ্রামের আব্দুল মনাফকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অশ্বিনী নাথকে রাজাকাররা নিয়ে গেল সৈয়দপুর বাজার ক্যাম্পে একদিন আটক রেখে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্যরা রায় দিলেন গুলি করে হত্যা করার। পরদিন দুপুরে মিনাজ পুরের পুলে নিয়ে দাড় করিয়ে অশ্বিনীনাথকে গুলি করে হত্যা করে রাজাকারা। দেশ স্বাধীনের পর তার ভাই মামলা করেছিলেন, ৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর এই মামলা আর এগুয়নি। এর পর তার ভাই মারা যান পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বাড়ি বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমান। বোয়ালজোর গ্রামের আব্দুল মনাফকে বোয়ালজোর এবং দাউদ গ্রামের মধ্যবর্তি স্থানে সৈয়দপুর বাজার ক্যাম্পের রাজাকারা গুলি করে হত্যা করে। তিনি রাজাকার দেখে ভয়ে পালাতে চাইছিলেন, নৌকা থেকে রাজাকরা তাকে পানির মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। তার মামলারও একই অবস্থা গরীব বিধায় কেউ নেই এই সরকারের আমলেও এব্যাপারে কেউ আর এগুয়নি।
এলাকার প্রতিটি মানুষই আতংকে থাকত কখন কাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায়। আমাদের এলাকায় সৈয়দপুর বাজাবে ছিল রজাকারদের বড়ঘাটি। একদিন ২০/২৫জন রাজাকার ঢুকে পড়ল বহরমপুর গ্রামে এই গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুসিত। গ্রামের মহিলাদের রেইপ করা সহ লুটতরাজ চালায় সৈয়দপুর ক্যাম্পের রাজাকাররা।
আমাদের এলাকার চানপুর গ্রামের জগাই-এবং মটর নামে দুই ভাই ছিল এরা পেশায় মৎস্যজীবী হলেও কৈলানপুর থেকে শেরপুর গয়না নৌকা চালাত। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাদের ভাল বাসত। প্রায়ই এদের গয়না নৌকায় শেরপুর থেকে বাড়ি আসতাম। যুদ্ধ শুরু হওয়াতে তারা রুট পাল্টে গোয়ালাবাজার থেকে কৈলানপুর পর্যন্ত গয়নার নৌকা চালাত। একদিন সৈয়দপুর ক্যাম্পের রাজাকাররা এই দুই সহোদরকে ধরে নিয়ে গেল, সাথে নিয়ে গেল আমাদের গ্রামের আব্দুল মতলিব উপফে মতুল ভাইকে। আমার চাচা শফিকুল হক চৌধুরী এদের ছাড়াতে রাজাকারদের মাধ্যমে অনেক ভাবে চেষ্টা করেছেন, ছাড়েনি নিয়ে গেল ক্যাম্পে, এর পর শান্তিকমিটির নেতা সৈয়দ সঞ্জব আলী এদের তুলে দেন শেরপুরে পাঞ্জাবীদের হাতে। মতুল ভাই মাদ্রসায় লেখা পড়া করেছেন ভাল উর্দু ও হিন্দি জানতেন, তিনি পাকস্তানীদের ববলেন তাকে শত্রুতা বশত ধরে নিয়ে এসছে। তার পরেও তাকে পাকিস্তানীরা নির্যাতন করেছে। একজন মেজরের দয়া হওয়াতে তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি দুদিন পর বাড়ি আসলে তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, পাকিস্তানীরা জগাই ও মটরকে লাথি মারতে মারতে হত্যা করে এর পর এদের লাশ ফেলে দেয় কুশিয়ারা নদীতে। এটা শুধু আমাদের এলাকার ঘটনা নয় সমগ্র দেশেই রাজাকারা এভাবে হত্যা করেছে নিরপরাধ বাঙ্গালীদের। জগাই ও মটরের স্ত্রীরা দেশ স্বাধীনের পর মামলা করেছিলেন ৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর তাদের মামলারও একই অবস্থা হয়। এখান চালিয়ে নেবার মত এদের পরিবারে এমন কেউ নেই যে বিচারেরর জন্য দাড়ায়।
আমি যখন শ্রীরামসী স্কুলে পড়ি তখন আমার বোনের বাড়ীতে লজিং থেকে পড়া শুনা করতেন সিলেট সদর বর্তমান দক্ষিনসুরমা উপজেলার পূরান গাঁও গ্রামের মনু মিয়া। ৭১ সালে মনুমিয়া দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানীদের আক্রমন করতে গিয়ে ধরা পরে যান পাক বাহিনীর হাতে। পরে জানতে পারলাম পাকিস্তানীরা মনুমিয়াকে গ্রেনেড দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেছে। তার লাশটিও পাওয়া যায়নি।
সমগ্র দেশে যুদ্ধ চলছে, বিদেশের সাথে যোগাযোগ বন্ধ বিশেষ করে আমাদের মত প্রবাসী পরিবারগুলো দারুন অর্থ সংকটে। দয়ামীরের আমার তালতো ভাই আব্দূল ওয়াহিদ (পরবর্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য) ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সোর্স তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল ভারতের করিমগঞ্জে। তখন লন্ডন থেকে আমার বড় বোনের স্বামী হারিছ মিয়া, করিমগঞ্জে একজনের কাছে লন্ডন থেকে পাঠান ৫০০ টাকা। আমার তালতো ভাই আব্দুল ওয়াহিদ এই টাকা নিয়ে আসেন করিমগঞ্জ থেকে। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে আমার বোনকে নিয়ে এসেছিলাম আমাদের বাড়িতে। তালতো ভাই আব্দুল ওয়াহিদ এই টাকা নিয়ে আসেন আমাদের বাড়িতে। এই টাকা না পাইলে আমাদের আরো কষ্ট করতে হত। যার কাছে টাকা পাঠিয়ে ছিলেন তিনি তাদের গ্রামের রানা বাবু তারা ৭০ এর পুর্বে ভারতে চলে গেছেন, তারা করিমগঞ্জে থাকেন। আমার তালতো ভাই আব্দুল ওয়াহিদ করিমগঞ্জে গেলে রানাবাবু তার হাতে টাকা দেন।
বলতে ভূলে গিয়েছিলাম যুদ্ধের শুরুর দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর সদস্য সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্য হয়ে আশ্রয় নিলেন আমাদের গ্রামের মসজিদে। এই ব্যাক্তিকে মসজিদে দেখে পাকিস্থান পন্থি আহমদ মৌলানা বললেন দেখ মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করেছে। এ কথা শোনা মাত্র মুক্তিযোদ্ধা ষ্টেনগান নিয়ে তারদিকে ধেয়ে আসলে তিনি বলেন আমার ভূল হয়েছে। আর কোন দিন এমটি বলবনা। গ্রামবাসির অনুরোধে এই মুক্তিযোদ্ধা আহমদ মৌলানাকে হত্যা করেনি। নাহয় মেরে ফেলতো ।
এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়, ছোট বাচ্চারা বলতো জয় বাংলা, একদিন সৈয়দপুর ক্যাম্প থেকে কয়েকজন রাজাকার নিয়ে আসেন সৈয়দ সঞ্জব আলী চেয়ারম্যান আমাদের বাড়িতে। তখন আমার চাচাতো বোনের মেয়ে খয়রুর বয়স চার বছর (এখন আমেরিকাতে থাকে) হঠাৎ করে রাজাকারদের সামনে গিয়ে জয়বাংলা জয়বাংবালা স্লোগান দিতে থাকে। আমরা সকলে ভয়ে অস্থির, হয়তো রাজাকারা আমাদের হত্যা করবে। শিশু বিধায় কিছু করেনি।
অক্টোবরের শেষ দিকে সৈয়দপুর ক্যাম্পের দু‘জন রাজাকার উমর পুরের সৈয়দ বাতির আলী ও নূরগাঁয়ের গ্রামের আবুল ফজল চৌধুরী – কাকুরা গ্রামের এক কাছা নামে ব্যাক্তিকে গাজা ও নাসির বিড়ি বিক্রির অপরাধে গ্রেফতার করে। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ সঞ্জব আলী এই দুই রাজাকার দিয়ে আটক ব্যাক্তিকে নবীগঞ্জ থানায় পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাজাকাররা একটি নৌকা করে ইলাইশ্শার খালে পৌঁছালে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি নৌকা এসে এই রাজাকারদের ধরে নিয়ে যায়। গ্রামে খবর আসলে রাজাকারদের বাড়ীতে উঠে কান্নার রোল, মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে চলে যায় দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ গ্রামে। তখন ভাটি অঞ্চল ছিল মুক্তাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে। পরিবারের অনুরোধে রাজাকারদের উদ্ধার করতে উমরপুরের সৈয়দ মসুদ আলী, কামারগাঁও এর আব্দূল মতিন চৌধুরী ছুরুক মিয়া ও পুরাদিয়ার মখলিছুর রহমান চৌধুরী ওই রাতেই আরেকটি নৌকা নিয়ে কুলঞ্জ গ্রামে পৌঁছান। কুলঞ্জগ্রামে যাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে উঠে তারা আমাদের আত্মীয়। কুলঞ্জের গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী রাজাকার ও মুক্তিযদ্ধাদের নিয়ে দিরাই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেলে দেখা যায়, যেসব মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা যুদ্ধ বাদ দিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয় এমনকি মুক্তিবাহিনীর সাথে তাদের যোগাযোগও ছিলনা। দিরাই ক্যাম্পের মুক্তিবাহিনী রাজাকারদের ছেড়ে দেয় এবং বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে। মুক্তিপাওয়া রাজাকার আবুল ফজল চৌধরী, সৈয়দ বাতির আলী ও উদ্ধারকারী মখলিছুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মতিন চৌধুরী ছুরুক মিয়া, সৈয়দ মশুদ আলী কিভাবে রাজকারা আটক হল এবং তাদের দিরাই থেকে নিয়ে আসা হল এর বিস্তারিত খুলে বলেন।
এখানে আরেকটি কথা অবশ্যই বলা দরকার, এমন বিপদের সময়ে সকলে ইচ্ছে করে পাকিস্তানীদের সহযোগীতা করেনি। পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেককে পিস কমিটির খাতায় নাম লিখাতে হয়েছে। এমন মানুষও ছিলেন যারা মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক। অনেক গ্রাম থেকে ইচ্ছে করে কিছু লোককে বাছাই রাজাকার বাহিনীতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে গ্রাম বা এলাকাটি রক্ষা পায়। এদের অনেকেই আবার রাতের বেলায় মুক্তিবাহিনীর লোকদের আশ্রয় দিয়েছেন। এমনও দেখা গেছে মুক্তিবাহিনী আসছে ব্রিজ বা কালভার্ট গুড়িয়ে দিতে বা পাকবাহিনীকে আক্রমন করতে এলাকাবাসী তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন, এই ভয়ে পরে পাকিস্তানীরা সমগ্র এলাকা ধ্বংশ করে দেবে। কোন কোন পরিবারে দেখা গেছে পিতা শান্তি কমিটির সদস্য, ছেলে মুক্তিযোদ্ধা, একভাই রাজাকার অন্য ভাই মুক্তিবাহিনীর সদস্য। এমটি ছিল নিজ নিজ এলাকা রক্ষারর্থে। যারা পেয়ারে পাকিস্তান বিশ্বাস করত তারাই ইচ্ছেকৃত ভাবে পিস কমিটি বা রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এরা ছিল জামাতি-মুসলিমলীগ বা অন্য কোন ইসলামী পন্থি দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী। এদের আজও সহজে চিহ্নিত করা যায। আবার কেউ বা লুটতরাজ করতে রাজাকার হয়েছে এমন সুবিধাবাদির সংখ্যাও কম ছিলনা। এমনও দেখা গেছে এলাকার পাকিস্তানপন্থি শান্তিকমিটির সদস্যরা নীরিহদের জোর করে রাজাকার বানিয়েছে। আর একারণেই পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধু সাধারাণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।
দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ গ্রামের দূর সম্পর্কীয় আমাদের চাচাত ভাই হারুন ভাইসাহেব মুক্তিবাহির সদস্য ছিলেন, যুদ্ধকালীন সময় তিনি এবং তার সাথের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলার জিবদারা গ্রামে, পাকিস্তানী দালাল এই বিশ্বাসঘাতকরা তাদের হত্যা করে গোয়ালঘরে লাশ পুতে রাখে। বিষয়টি আমরা জানতে পারি দেশ স্বাধীনের পর। ঠিক অনুরুপ ভাবে কুলঞ্জগ্রামের আমাদের আরেক চাচাত ভাই কুলঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তছদ্দুক আহমদ চৌধুরী তছু ভাইসাহেবকে স্থানীয় রাজাকাররা হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় নদীতে, পরে লাশ উদ্ধার করা হয়। অনুরুপ ভাবে ফেঞ্চগঞ্জের মউরাপুর গ্রামের আমাদের এক তালত ভাইকে হত্যা করে স্থানীয় রাজাকাররা।
মুক্তিযোদ্ধের পুরো নয় মাস সমগ্রদেশে ছিল আতংক কখন কার উপর আক্রমন হয়, বলা যায় না। মানুষ পাকিস্তনিদের এতটাই ভয় করতো দেখা গেছে পাকিস্তীরা গ্রামে বা মহল্লায় প্রবশে করলে মা তার শিশু সন্তানকে বিছানায় রেখে সন্তান মনে করে বালিশ নিয়ে দৌড়াচ্ছে। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সমগ্র দেশে। আমার মেঝ বোনের ননদের শ্বশুরী ইশবপুরের লিলুর দাদী তাদের গ্রামে পাকিস্থিানী সৈন্যরা প্রবেশ করে বাড়ি বাড়ি লুট করছে তখন এই বৃদ্ধ মহিলা ভয়ে কোরআন শরীফ নিয়ে পড়তে বসেছেন, পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখে ভয়ে বার বার বলছেন আইকুম আসসালাম, আস্সালামুয়ালাইককুম বলতে ভূলে গেছেন ভয়ে। মানুষজন এদের বিভৎস রুপ দেখলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলত।
নভেম্বরের শেষ দিকে দুলাভাই লন্ডন যাবেন তাকে সিলেট এয়ারপোর্ট প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে বাড়ী ফিরছেন আমার ভাই। পর পরই চেক পোষ্ট, প্রথম দেখলেন সিলেট শহর থেকে বের হয়ে তেতলীর পুলে পাকিস্তানী সৈন্যরা গাড়ী থেকে নামিয়ে একে একে সকলকে চেক করছে বেগ তল্লাসী করছে। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেশ করছে তুমার বেগে কি আছে। এই ভদ্রলোক ঠিক মত উর্দু বলতে পারেননা, বললেন কুচ…নি‘‘ হে… মেরা বেগকো অন্দর দু‘পাঞ্জাবী হায়। তখন পাকিস্তানী আর্মি তার বেগ খুলে দটি পাঞ্জাবী পেল। বলল শালা তুম জুট বলতা পাঞ্জাবী কাহা হায়। তাকে গুলি করতে চাইলে এক মৌলানা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের দেশে এইটাকে পাঞ্জাবী বলা হয়। তার পরেও পাকিস্তনী সৈন্যরা এই ভদ্রলোক এবং মৌলানাকে গুলি করল। ভয়ে তারা অস্থির, আরেকটু এগুতে দয়ামীর বাজারে রাজাকাররা ঠিক একই ভাবে চেক করছে। তার ভাষ্যমতে মাদ্রাসা ছাত্র এক রাজাকার রাইফেলের চেয়ে বেটে, সে তাদের বারবার প্রশ্ন করল শেষ পর্যন্ত তাদের সব টাকা পয়সা কেড়ে নিল।
নভেম্বরের শেষ দিকে ক্রমান্বয়ে মুক্তিবাহিনীর আক্রমন বাড়তে থাকলে মনে জোর পাই দেশ স্বাধীন হতে বিলম্ভ হবেনা।
৬ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধ শুরু হলে মানুষের মনে আসা জাগে। ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ অগ্রাহায়ন মাস চলছে ধান কাটা, আমি বাড়ির উত্তর ধান কাটা দেখতে যাই। যুদ্ধ শুরু হবে এই ভবে প্রতিটি বাড়িতে বাংকার খনন করা হচ্ছে আক্রমন হলে সকলে যাতে ভাংকারের ভেতর আশ্রয় নিতে পারেন। আমদের বাড়িতে চার/পাঁচটা বাংকার খনন করা হয়। তখন দেখলাম একটি প্লেন খুব ধীরগতিতে আসল এসে শেরপুর ক্যাম্পে ছবি তুলছে। নীচ থেকে পাকিস্তানীরা এই প্লেনটিকে লক্ষ করে বার বার মেশিন গানের গুলি ছুড়ছে, আমরা চেয়ে চেয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। এই প্লেনটি চলে যাবার পরপরই আসল দুটি ভারতীয় জঙ্গি বিমান শেরপুর ক্যাম্পে উপর থেকে শেল ছুড়তে থাকে। এর পরদিন ভারতীয় বিমান থেকে শেরপুর ক্যাম্পে পাকিস্তানীদের হামলা করলে হুসেনপুর গ্রামের এক মহিলা ও কুমারখাদা ঘাটে ঢাকার একজন ধানব্যবসায়ী নাইয়া বিমান থেকে ছোড়া শেলের আঘাতে প্রাণ হারান তারা বিমান আক্রমন দেখতে বেড়িয়ে ছিলেন।
ওই রাতেই আমি কলেরা রোগে আক্রান্ত হই। আমি আমার মেজো বোন ছাদিয়া খানম চৌধুরী ও বাড়ির আরো কয়েকজন। কলেরায় মারা গেলেন আহমদ মৌলানার স্ত্রী ও আমাদের বাড়ীতে থাকতেন মৌলভীবাজারের কালিয়ার গাউয়ের ফখর উদ্দিন মৌলানা। সকালে আবার ভারতীয় বিমান হামলা চালালো শেরপুর ক্যাম্পে, সকলে ভয়ে বাংকারে প্রবেশ করলেন আমার মা আমার পাশে বসে রইলেন, তিনি আমাদের ফেলে যাননি। তখন মানুষ কলেরা বেমারকে খুব ভয় পাইতো। ১৬ তারিখ পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পন করল আমার বড় ভাই খলিলুর রহমান চৌধুরী আমার মাথার কাছে এস বললেন দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীনের আনন্দ মিছিলে শরিক হতে পারিনি।
আমাদের গ্রামের বারিক ভাই কয়েকজন মানুষ নিয়ে আমাদের ধান কাটার ব্যবস্থা করলেন, শ্রীরামসী থেকে তালইকে নিয়ে আসলেন। এই মানুষটির কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। এই মানুষটি না হলে আমাদের উপায় ছিলনা ভয় ভীতি উপেক্ষা করে বিপদে আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর একাত্তরের পর স্মৃতি থেকে যা মনে পড়ছে তুলে ধরলাম।
পাকিস্তান বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় জেনে ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে পরিকল্পনা করে দেশের বুদ্ধিজীবদের হত্যার। পাকবাহিনীর অন্যতম সহযোগী আলবদর কমান্ডার জামাত নেতা মতিউর রহমান নিজামী বুদ্ধিজীবি হত্যার পরিকল্পনা করে। দেশের শ্রেষ্ট সন্তান শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবি ও চিকিৎসকদের বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। তাদের রায়ের বাজাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবি হত্যার অন্যতম নায়ক আলবদর কমান্ডার চৌধুরী মইনুদ্দিন এখন লন্ডনে মুসলিম কমিউনিটি লিডার। আমরা পারিনি বুদ্ধিজীবি হত্যার বিচার করতে এটি আমাদের ব্যর্থতা।
পাকহানোদদের আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে কেন জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না, ইদানিং অনেকের মুখে একথা শোনা যায়। বিশেষ করে ভারত বিদ্ধেসি এবং পাকিস্তানপন্থিরা একথা বলে। জেনারেল ওসমানী ছিলেন বাংদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান, এছাড়া আরেকটি কথা বলা প্রযোজ্য ভারত বাংলাশেকে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। আন্তর্জাতিক আইনে সেখানে যদি পাকিস্তান ও ভারতীয় সেনাবাহিন প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন তাহলে সেখানে জেনারেল ওসমানীরও উপস্থিতি জরুরী ছিল। ভারতীয় কমান্ডার অরোরা এবং পাকিস্তানী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার নিয়াজির র্যংক ওসমানীন সমান নয়। তার সহকারী এ.কে খন্দারকে পাঠানো হয় বাংলাদেশ সেনাবাহীর পক্ষে। জেনারেল ওসমানী ছিলেন খুবই আত্মমর্জাদা সম্পন্ন মানুষ। একারনে তিনি সেখানে উপস্থিত না হয়ে তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। এমনটি বলেছেন সদ্য প্রয়াত ড. জাফর উল্লাহ চৌধুরী তার ভাষ্য মতে ১৬ তারিখে সিলেটে জেনারেল ওসমানীর হেলিকাপ্টারে গুলি করা হয় ওই হেলিকাপ্টারে ওসমানীর সাথে ছিলেন ডাঃ জাফর উল্লাহ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল। শেখ কামাল ছিলেন তখন জেনারেল ওসমানীর পিএস।