লন্ডনে নির্বাসনে থাকা পাকিস্তানের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সাধারণ নির্বাচনের তিন মাস আগে দেশে ফিরেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার। অসুস্থতার কারণে নওয়াজ শরিফ জামিন নিয়ে ২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনে যান। তবে শর্ত ছিল- তিনি সুস্থ হলেই ফিরে যাবেন পাকিস্তানে। কিন্তু পরে তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে যাননি।
পাকিস্তান মুসলিম লীগের ৭৩ বছর বয়সী এই নেতা বরাবরই বলে আসছেন, তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ মিথ্যা। তড়িঘড়ি করে তার বিচার শুরু করা, দোষী সাব্যস্ত করা ও কারারুদ্ধ করা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
নওয়াজ শরিফের সাজা বাতিল
পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত নওয়াজ শরিফ কখনো তার কোনো মেয়াদ শেষ করেননি। ১৯৯৩ সালে দুর্নীতির দায়ে তাকে বরখাস্ত করা হয় এবং ১৯৯৭ সালে তিনি এই পদে ফিরে আসেন। মাত্র দুই বছর পর দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর নির্দেশে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
২০১৭ সালে দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট তাকে রাজনীতি থেকে আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। ২০২০ সালে লন্ডনে থাকাকালীন পাকিস্তানের একটি আদালত নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
তবে চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসলামাবাদের হাইকোর্ট নওয়াজ শরিফকে সুরক্ষামূলক জামিন দেয়। এই জামিনের অর্থ হলো, বিচারকদের সামনে হাজির হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষ তাকে আটক করতে পারবে না। আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে নওয়াজ শরিফকে গ্রেপ্তারের হুমকি নেই এবং শনিবার (২২ অক্টোবর) তার রাজনৈতিক কেন্দ্র লাহোরে একটি স্বাগত সমাবেশ করার পথ সুগম হয়েছে।
নওয়াজ শরিফ পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না বা সরকারি পদে থাকতে পারবেন না। যদিও তার দল বলেছে, তিনি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে চান।
নওয়াজের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ বলেছেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে তিনি যাতে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন, সেজন্য দুর্নীতির সাজা বাতিলের চেষ্টা করবেন।
আউট হলেন ইমরান খান
নওয়াজ শরিফ তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খানের ভোটারদের নিজের অনুকূলে ফিরিয়ে আনতে চান। ইমরান এখন দুর্নীতি মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটের পর সাবেক এই ক্রিকেটারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও তিনি এখনও দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত। ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণের পর থেকে পাকিস্তান মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে।
নওয়াজ শরিফের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে পাল্টে দেবে বলে ব্যাপকভাবে আশা করা হচ্ছে। পিএমএল-এন পার্টির আইনপ্রণেতা মাইজা হামিদ বলেন, এটি একটি বিশাল মুহূর্ত এবং বড় অগ্রগতি। ফিরে আসার পর নওয়াজকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলে আদালত জানিয়েছে। শনিবার লাহোরে এক সমাবেশে সরাসরি ভাষণ দেবেন তিনি।
‘পাঞ্জাবের সিংহ’ কি চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবে?
শরিফের কিছু বিরোধী মনে করেন, তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কিছুটা প্রহসন। ইমরান খানের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা জুলফিকার বুখারি বলেন, নওয়াজ শরিফ মূলত ভুয়া মেডিকেল রিপোর্ট উপস্থাপন করে চিকিৎসার জন্য চলে গিয়েছিলেন।
কয়েক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শরিফ তার দলীয় রাজনীতি পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা করছেন। ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ অজনপ্রিয় জোট সরকারের নেতৃত্ব দেন।
নওয়াজ শরিফের পাকিস্তানে চতুর্থবারের মতো প্রত্যাবর্তন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশার ইঙ্গিত দেয়। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো মাদিহা আফজাল বলেন, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত নওয়াজের ভাই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনিই লন্ডন থেকে সবকিছু পরিচালনা করতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই ক্যারিশম্যাটিক এবং তার দলের রাজনৈতিক ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করার চাবিকাঠি হবেন।
সামরির বেড়া অতিক্রম করেছেন নওয়াজ?
ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, নওয়াজ শরিফ ও তার দল সামরিক বাহিনীর সদিচ্ছায় ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর আগে শরিফ ও তার দলের সাথে চুক্তির কথা অস্বীকার করেছিল। তার প্রত্যাবর্তনে সেনাবাহিনীর সমর্থন আছে বলে মনে হচ্ছে। তবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খান এখনও খুব জনপ্রিয়, যদিও তিনি কারাগারে রয়েছেন এবং তার দলটি মূলত ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নওয়াজ শরিফের সমর্থন, রাজনীতিবিদ হিসাবে তাকে জনপ্রিয়তা এনে দেবে না। প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে সমর্থন পাওয়া এক জিনিস আর কিন্তু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া অন্য জিনিস। এখনও ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় দল।