এই প্রজন্ম যন্ত্র বোঝে, কিন্তু মানুষ বোঝে না। তারা ধান্দা বোঝে, ‘ধর্ম পালন’ বা ‘জিহাদ’ বোঝে, স্বার্থ বোঝে, আর যেনতেন প্রকারে বড়লোক হওয়া। যে কোনো উপায়ে বড়লোক হওয়াই এখন ‘ক্যারিয়ার’। এর বাইরে তাদের অন্য কোনো চিন্তা নেই। তারা অতীত জানে না, ইতিহাস জানে না, জানতে চায়ও না।
আমাদের জীবনে আপদের কোনো শেষ নেই। যানজট, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের খেয়োখেয়ি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, মশার বিষাক্ত কামড়, টকশোর বক্তাদের একঘেয়ে প্যাঁচাল, রাস্তায় ভিখারির বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান, ঘরে বউ-বাচ্চার বাহুল্য প্যাঁচাল, জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম ইত্যাদি সমস্যা ও সংকটে আমাদের জীবন অস্থির। এর মধ্যে ইংরেজি নববর্ষ আমাদের জীবনে এক নতুন আপদের নাম।
বর্ষবরণের নামে আমাদের দেশে এখন রীতিমতো উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের নগরবাসী সাড়ম্বরে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করে। পূর্ববর্তী বছরগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, এই আনন্দ উৎসব উদযাপনের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে থাকে। কতিপয় ব্যক্তি আনন্দের আতিশয্যে পটকাবাজি, আতশবাজি, অশোভন আচরণ, বেপরোয়া গাড়ি ও মোটরসাইকেল চালানোর মাধ্যমে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রকাশ্যে অভদ্রজনোচিত আপত্তিকর আচরণ করে থাকে। এসব নৈতিক মূল্যবোধ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা সৃষ্টি করে।
এখন ইংরেজি নববর্ষ মানেই সাজ সাজ রব। শহর-নগরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মহা-উত্সবের সমারোহ। আলোর ফোয়ারা। রাতের ঘুম হারাম। গ্যালন গ্যালন মদ গেলা। বিভিন্ন স্যাটালাইট চ্যানেলে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের নর্তন-কুর্দন। বস্ত্রসংকট প্রদর্শনী!
নতুন বছরকে ঘিরে একশ্রেণির মানুষ কেন এমন ‘ক্ষ্যাপাটে’ হয়ে ওঠে, তার কারণ নির্ণয় করা দুষ্কর। এই উত্তেজনা ও উন্মাদনার কোনোই মানে নেই। মহাকালের নিয়মেই নতুন বছর আসবে, পুরোনো বছর বিদায় নেবে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কখনো কোথাও ঘটেনি, ঘটা সম্ভবও নয়। পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরী যদি নিবিড় আলিঙ্গনে পুরোনো বছরকে ধরে রাখতে চায়, তবু তারা সফল হবে না। আবার পৃথিবীর সব মারণাস্ত্র তাক করলেও নতুন বছরের আগমন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কালের নিয়মেই নতুন বছর আসে, পুরোনো বছর বিদায় নেয়। তাছাড়া পুরোনো বছর যেমন আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায় না; তেমনি নতুন বছরও আমাদের জন্য নিশ্চিত কোনো সৌভাগ্যের চাবি হাতে করে আসে না। আমরা আমাদের কর্ম, নেতানেত্রীদের আচরণের ফল ভোগ করি মাত্র। সেদিক থেকে বিচার করলে নতুন বছরের আগমন আর পুরোনো বছর চলে যাওয়ায় আমাদের কিছুই যায়-আসে না। পুরোনো বছরকে বিদায় জানানো আর নতুন বছরকে বরণ—উভয়ই তাত্পর্যহীন।
তার পরও আমরা নতুন বছরে আন্দোলিত, উত্তেজিত হই। নতুন বছরকে বরণ করার জন্য হইহই কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলি। বিশেষ করে শহর-নগরে বসবাসরত নতুন প্রজন্ম। তাদের উদ্দাম-উচ্ছ্বাস-উদ্যোগ-আয়োজন আর উত্তেজনা দেখে মনে হয় যেন কিয়ামত সমাগত। যা কিছু করার, যা কিছু খাওয়ার এবং পান করার, তা ৩১ ডিসেম্বর রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে। ১ জানুয়ারি ঘটবে মহাপ্রলয়। এই মহাপ্রলয়ের আগে তারা বিভিন্ন বাসার ছাদে ছাদে শামিয়ানা টানিয়ে উচ্চ স্বরে বিজাতীয় গান বাজিয়ে নেচেগেয়ে পান করে নরকগুলজারে মশগুল হয়ে পড়ে। আরেক দল নগরীর বিভিন্ন নামিদামি হোটেলে-বারে আকণ্ঠ পান করে কলির দেবদাস হওয়ার সাধনায় মগ্ন হয়।
নতুন আরেকটি অংশ (নব্য বড়লোকের অশিষ্ট, বখে যাওয়া উঠতি যুব বাচ্চারা) নানা ধরনের বিজাতীয় খাবার শক্ত-তরল মিলিয়ে গলা অবধি সেঁটিয়ে শরীরের উত্তাপ বশে রাখতে না পেরে গাড়ি করে সবান্ধবে বেপরোয়া উদ্দেশ্যহীন ছুটোছুটি করে। তাদের গাড়িতে বাজে উচ্চ স্বরের মিউজিক। আরো এক দল দেখা যায়, যারা কোনো কিছু ‘না খেয়ে না পেয়ে’ও বেহুদা ছোটাছুটি করে। এই রাস্তা থেকে ঐ রাস্তায় যায়। এই নতুন প্রজন্ম ৩১ ডিসেম্বর রাতে পাগলা ষাঁড়ের মতো হয়ে যায়। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। তাদের কারণে পুরো ঢাকা শহরে একটা ‘কী যেন কী যেন হয় অবস্থা’র সৃষ্টি হয়। নতুন বছরকে বরণ করার নামে এই ক্ষ্যাপাটে উন্মাদনা ঠেকাতে সরকারকে চিন্তিত ও বিচলিত হতে হয়। বর্ষবরণের নামে যৌবনের বেপরোয়া উচ্ছ্বাস ঠেকাতে ‘রেড অ্যালার্ট’ ঘোষণা করতে হয়। নিউ ইয়ারের অনুসারীদের বশে রাখতে নানা ফন্দি ও পরিকল্পনা আঁটে। হাজার হাজার পুলিশ-র্যাব-কুকুর মোতায়েন করে। অস্ত্র উঁচিয়ে এসব বাহিনীকে মোড়ে মোড়ে পাহারা বসাতে হয়। যেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। যে কোনো মুহূর্তে হানাদার বাহিনী গর্জে উঠতে পারে। কাজেই সারাক্ষণ সতর্ক প্রহরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বেচারারা শীতের রাতে না খেয়ে না ঘুমিয়ে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে নিউ ইয়ার-প্রেমী উন্মাদদের মুখের গন্ধ শোঁকেন। তাদের সামাল দিতে হিমশিম খান।
৩১ ডিসেম্বরের রাতটা নিয়ে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভীষণ টেনশনে থাকেন। এই রাতটা ভালোয় ভালোয় পার হয়ে গেলে সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন! অথচ আমাদের সুখের ঘরে ইংরেজি নববর্ষ পালনের এই উটকো ঝামেলা বা হুজুগ আগে ছিল না। ছোটকালে ক্যালেন্ডারের পাতায় ছাড়া ইংরেজি নববর্ষের কোনো অস্তিত্ব আমরা কোথাও দেখতাম না। তখন অবশ্য দেশে এত লোকও ছিল না। অল্প কিছু লোক চাকরি-বাকরি করতেন। তাদেরই ইংরেজি সন-তারিখের দরকার হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ইংরেজি তারিখ ব্যবহার হতো। তবে অনেক সনাতনপন্থি শিক্ষক বাংলা তারিখ ব্যবহার করেই কাজ চালিয়ে নিতেন। কৃষিনির্ভর চাষা-ভুষাদের সমাজে ইংরেজি ভাষা, ইংরেজি মাস-বছর সবই ছিল বাহুল্য।
এখন সময় পালটেছে। এখন ঘরে ঘরে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ! হালি হালি গণ্ডা গণ্ডা মানবসন্তান। ‘কাউয়া’ গুনে শেষ করা যায়; কিন্তু মানুষের বাচ্চা গুনে শেষ করা যায় না। কৃষিনির্ভর সমাজের পরিবর্তে এক বারোয়ারি পেশার সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সমাজে বাংলা সনের অবস্থা হয়েছে ‘মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো’ ভবঘুরের মতো। পাশ্চাত্য মডেলের পোশাক পরে, স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখে, দু-চারটা ইংরেজি গালি আর বুলি ঝেড়ে আমরা একেকজন বিরাট সাহেব বনে গেছি। এই সাহেব জমানার আমরা নাম দিয়েছি আধুনিকতা। এসব নিয়ে কোনো কথা বললেই লেভেল সেঁটে দেওয়া হয়—‘আনস্মার্ট’। আমরা কেউই এখন ‘আনস্মার্ট’ হতে চাই না। তাতে আমাদের ইজ্জত যায়।
অনেকে আবার আগ বাড়িয়ে জিগ্যেস করবে, নতুন বছরের প্ল্যানটা কী? কী এক্সপেক্ট করছেন? এসব কথা শুনলে মাথার তালু গরম হয়ে যায়। ইচ্ছে করে বাটার শক্ত জুতা দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে নিজের কপাল নিজেই ছেঁদা করি। আরে নরাধম, নতুন বছরের আবার প্ল্যানটা কী? প্ল্যান কি আমাদের জাতীয় জীবনে আছে? কখন কী ঘটবে তা কি আগেভাগে কেউ বলতে পারবে? আমাদের দেশে কোনো কিছুই কি প্ল্যান মাফিক হয়? আমাদের জীবনে প্ল্যান হচ্ছে ঘোড়ার আন্ডা, যা কোনো ঘোড়া কোনো কালে পাড়েনি, কখনো পাড়বেও না!
আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতায় অবহেলায় একটু একটু করে একটা নতুন ধরন, একটা নতুন আচরণ ও সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামী দিনের কান্ডারি যারা, সেই তরুণ ও যুবসমাজ অন্যরকমভাবে সমাজে বড় হচ্ছে। একটা অলীক ফাঁপা অন্তঃসারশূন্য জগৎ তারা নির্মাণ করছে। এই প্রজন্মের অন্যতম সৃষ্টি ‘নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন’। এটা নিয়ে তারা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করে, মাতামাতি করে। অথচ বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাধা দেবেই-বা কে? তাদের কোনো কাজে বাধা দিলেই তারা বলবে—ব্যাকডেটেড, আনস্মার্ট। একালের অভিভাবকেরা সবকিছু হতে প্রস্তুত আছেন, শুধু আনস্মার্ট ছাড়া!
শিকড়বিচ্যুত অতীতবিমুখ এমন প্রজন্ম গড়ে তোলা হচ্ছে, এমন শিক্ষায় তাদের তালিম দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিধির বিধান পালটে গেলেও তা সংগত মনে হবে। এই প্রজন্ম যন্ত্র বোঝে, কিন্তু মানুষ বোঝে না। তারা ধান্দা বোঝে, ‘ধর্ম পালন’ বা ‘জিহাদ’ বোঝে, স্বার্থ বোঝে, আর যেনতেন প্রকারে বড়লোক হওয়া। যে কোনো উপায়ে বড়লোক হওয়াই এখন ‘ক্যারিয়ার’। এর বাইরে তাদের অন্য কোনো চিন্তা নেই। তারা অতীত জানে না, ইতিহাস জানে না, জানতে চায়ও না।
এই তরুণ-যুবকদের কে বোঝাবে যে, উন্মাদনা, পাগলামি, মাতলামি করাটা মোটেও নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন নয়। নতুন বছরে আমরা কি পারব আমাদের স্বভাব-চরিত্র-আচরণ বদলাতে? পারব কি মানুষ হতে? মানবিক হতে? তা যদি না হয়, তো কীসের হ্যাপি নিউ ইয়ার? কেবল অবক্ষয়ের নষ্ট স্রোতে গা ভাসিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলে ফোনে, ইমেইলে, এসএমএসে এবং দেখা-সাক্ষাতে দাঁত কেলিয়ে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলার মধ্যেই নতুন বছরে আমাদের কর্তব্য শেষ করব?