বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে লাগাম টানাসহ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্যসংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এসব বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়াও মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহারের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য, খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করার কথাও এ ঘোষণায় রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, রেপো সুদহার আগের চেয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ শতাংশে পুনর্নিধারণ করা হয়েছে। এতে রেপো তথা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নেওয়া ধারের বিপরীতে সুদ দিতে হবে ৬ শতাংশ হারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে, চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে বেশির ভাগ দেশ সুদহার বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমার কারণে মুদ্রানীতির কার্যকারিতা অনেকাংশে কমে যায়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় টাকার হাতবদল কমে। এ পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও বাজারে তারল্য বাড়াতে সরকারের ঋণচাহিদার বেশির ভাগই দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা, আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণ কমিয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ফলে প্রথম সরকারের নিট ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া সিএমএসএমই, রপ্তানি উন্নয়ন, খাদ্যনিরাপত্তা ও কারখানা সবুজায়নে ৪৫ হাজার কোটি টাকার চারটি পুনঃ অর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে প্রতিদিনই রেপো, বিশেষ তারল্য সহায়তাসহ নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোকে প্রচুর ধার দেওয়া হচ্ছে।
গত ১৫ জানুয়ারি ব্যাংকের আমানতের ওপর বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতের সুদহার নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতের সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলো। এছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। বর্তমানে ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে এখন সেখানে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এর ফলে ব্যাংকগুলো এখন ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়াতে পারবে। তবে শিল্পঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, অন্যান্য ঋণের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন থাকবে।
উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয়ক্ষমতা কমায় গত অক্টোবরের তুলনায় গত নভেম্বরে ব্যাংক খাতের আমানত ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে। আমরা লক্ষ করছি, রেপোর সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশেই ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তবে ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে এ সুদহার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতদিন মৌখিকভাবে ভোক্তাঋণের সুদহার অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি ছিল। ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার পরিবর্তিত না হলেও ব্যাংক আমানতের সুদহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের নির্দেশনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট চলছে, বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজেদের নির্ধারিত সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ইতিহাস সৃষ্টি করা এ আমদানি দায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ৮ জানুয়ারি রিজার্ভের গ্রস পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এবার সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে, যা কিছুটা সংকোচনমুখী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। এসব নীতি হারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য প্রবাহ আর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে বাজেটে ঘোষিত সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপযুক্ত আর্থিক পরিবেশ তৈরি হয়, আবার বাজারে পণ্যমূল্যও সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়।
সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয়, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে বছরের পুরো সময়টায় বাজারে অর্থপ্রবাহ ও আঙ্গিক কেমন হবে, তাও মুদ্রানীতিতে ঠিক করে দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এনে খেলাপি ঋণের অঙ্ক কমানোর বিষয়টি উল্লেখ হয়নি এবং দীর্ঘ মেয়াদে সবার জন্য এক অঙ্কের সুদ নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। এছাড়াও প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহকে উত্সাহিত করার কোনো প্রণোদনা দেখা যায় না। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, যার জন্য নীতিগত গবেষণার প্রয়োজন। কারণ কেবল নীতি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, তার সফল বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে তার উৎকর্ষ। মুদ্রানীতির প্রবাহচিত্রে বলা হয়েছে অর্থ সরবরাহ অর্থাৎ ব্যাপক ও সংকীর্ণ অর্থ সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সঠিক স্থানে পৌঁছে দেওয়া—যা সার্বিক উৎপাদন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর সঙ্গে জড়িত আছে সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রার বিনিয়োগ হার। এগুলোর বাইরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রবাহ চিত্রগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে কোনো প্রকার মূল্যায়ন এই মুদ্রানীতির দলিলে পাওয়া যায় না।
মুদ্রানীতির শত ভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে, যা বর্তমানে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয় এ খাতে অনৈতিক কাজগুলো সার্বিক অর্জনকে কলুষিত করছে—যা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু। শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত বিরোধীদলীয় এক পার্লামেন্ট সদস্যের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন—ব্যাংকিং খাতে যা ঘটছে তা পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি এবং আইন করেও এই খাতের দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সুশাসনের বিষয়টি আর্থিক খাতে সফলভাবে প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে তপশিল ব্যাংকগুলোর আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে নজরদারি বাড়ানো পূর্বেকার মতো অব্যাহত রাখে। তবে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নের হার অনেকাংশে বাড়বে। তাছাড়াও এই খাতকে গতিময় করতে শুধু অর্থঋণ আদালতই যথেষ্ট নয়, বরং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। হিসাব অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন খাতে আনুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থের জোগান হয় তা দেশের জিডিপির প্রায় তিন শতাংশের সমান। সাধারণভাবে তত্ত্ব বলছে, দুর্নীতি বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্তিমিত করে, পণ্যমূল্যকে প্রভাবিত করে এবং সর্বোপরি সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে। কাজেই এসব সমস্যা সমাধান করে মুদ্রানীতির বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। তা হলেই দেশের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত পদ্ধতি রয়েছে, যেমন সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়—যা সঠিক নয়। আর্থিক খাতের সংস্কার ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করা (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার) এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংকগুলোর ভূমিকার ক্ষেত্রে আর্থিক বহির্ভূত উদ্যোগ ও অধিক উদ্ভাবনমূলক আর্থিক পণ্য, যেমন—তহবিল, উপাদান, বিপণনযোগ্য সিকিউরিটিজকে কার্যকর করে তোলার সময় এসেছে এবং এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সর্বশেষ অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯-এর প্রভাবের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করা উচিত, যা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষক এবং প্রান্তিক জনগণের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।