জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি একটি নির্বাচনী জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে জাপা নেতাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখা দলগুলো নিয়েই তাদের এই জোট হবে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে যোগাযোগ চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জাতীয় পার্টি ক্ষমতার কাছে থাকতে চায়। এজন্য তারা নির্বাচনের আগে একটি বড় বিরোধী রাজনৈতিক জোট করতে চায়। এ জোট ভারী করে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই আত্মপ্রকাশ করবে এই জোট। বড় দুই দলের বাইরে নতুন জোটের মাধ্যমে ভোটের আগে দর কষাকষিতে গুরুত্ব বাড়াতে চায় জাপা। এছাড়া জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ করছে দলটি। পাশাপাশি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দুটি দলের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা চলছে। এর বাইরে কয়েকটি ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গেও জাপার শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ বলেন, ‘দেশের মানুষের কাছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির মার্কাকে (লাঙ্গল) আবারও সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা থেকেই সব আসনে প্রার্থী নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ। ব্যক্তি হিসেবে ক্লিন ইমেজ রয়েছে তার। সব মহলে জনপ্রিয়তাও রয়েছে। দলকে চাঙ্গা করতে তিনি এরই মধ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মীরাও তার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন আসনে ক্লিন ইমেজের আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে। আর সামনের নির্বাচনে কেমন কীভাবে হবে কার সঙ্গে রাজনৈতিক জোট হবে এগুলো পরে ঠিক হবে, তবে এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী কাজ করছেন জি এম কাদের।’
জাপা সূত্র জানিয়েছে, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাওলানা মুহম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলের জোট হতে পারে। এবি পার্টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে এরই মধ্যে বৈঠক হয়েছে জাপার।
সরকারের সুরে কথা বলে বিরোধী দলের তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর। আগের তিনবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট করা জাপার ওই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, নির্বাচন ব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতিতে সমালোচনা করলেও সরকারের মূলনীতির সঙ্গে জাতীয় পার্টি রয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ ও দেশের রাজনীতিতে বড় কোনো বদল না হলে আগামী নির্বাচনেও জাপা আওয়ামী লীগের সহযোগীর ভূমিকায় থাকবে। বিএনপি ভোটে না এলে, জাপা সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। সরকারের প্রথম মতবিরোধ বিএনপির সঙ্গে, এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে আগামীতে জাপার নেতৃত্বাধীন এই জোট হবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল।
২০০১ সালে নির্বাচনে জাপার সঙ্গে জোট করে ভোট করে ইসলামী আন্দোলন (তখন নাম ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন)। আবারও জোট হবে কিনা এমন প্রশ্নে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাতীয় পার্টি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় পার্টির নৈকট্য রয়েছে। তবে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে এখনো আলোচনা হয়নি। জাপার সঙ্গে আলোচনা হবে তা স্বীকার করেছেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস আহমদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় চলছে। খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। জাপার সঙ্গে এখনো বসা হয়নি। সময়-সুযোগ অনুযায়ী সবার সঙ্গেই বসব। জাপার সঙ্গে জোট হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন শুধু মতবিনিময় চলছে। পরিবেশ অনুকূল হলে দেখা যাবে, জোট হবে কিনা।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক হয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করে। ভোটের পর বিএনপির সমালোচনা করে জোট ছাড়েন কাদের সিদ্দিকী। সরকারের সমালোচনা করলেও বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব মেটেনি তার দলের। গত মঙ্গলবার জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবীর। জাপা ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে কাদের সিদ্দিকী, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে ‘সমদূরত্ব’ রাখা দলগুলো একজোট করার কথা বলেন। তবে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, নির্বাচনের এখনো ১৫-১৬ মাস বাকি। আগাম নির্বাচনেরও সম্ভাবনা নেই। নির্বাচনী জোট হবে কিনা তা অনেক পরের ব্যাপার।
জাপা চেয়ারম্যানের বনানীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি জোট করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে জি এম কাদেরের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। মাথাউঁচু করে দাঁড়ালেই সাধারণ মানুষের আস্থার ঠিকানা হতে পারে জাতীয় পার্টি।’
কাদের সিদ্দিকী বলেন, মানুষের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের জন্যই এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে সব রাজনৈতিক শক্তিকে এক মোহনায় পৌঁছতে হবে। পরিচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে জি এম কাদেরের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। কোনো কূটকৌশল নয়, শুধু সাহস নিয়ে মাথাউঁচু করে দাঁড়ালেই সাধারণ মানুষের আস্থার ঠিকানা হতে পারে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনে দুটি জোট হবে, একটিতে সরকারি দল ও তাদের সমর্থকরা থাকবে। বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেবে জাতীয় পার্টি। আমাদের জোটে সমর্থন থাকবে দেশের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। যারা সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে তারাই শুধু সরকারি জোটে ভোট দেবে। আর নির্বাচন সুষ্ঠু হলে নির্যাতিত-নিপীড়িত বিশাল জনগোষ্ঠী বিরোধী জোটে ভোট দেবে। তাই জাতীয় পার্টির অবস্থান পরিষ্কার। জাতীয় পার্টি সাধারণ মানুষের কাতারে নেতৃত্ব দেবে। সেজন্যই এই জোট গঠন করা হচ্ছে।’