রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষই তার নাগরিক। নাগরিকদের রয়েছে একাধিক মৌলিক অধিকার, যা রাষ্ট্র দিতে বাধ্য। রাষ্ট্রে সুশাসন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে নাগরিকদের অধিকার প্রধান, মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং শাসনব্যবস্থায় নিরপেক্ষ নীতি বজার রাখার কোনো বিকল্প নেই। আইনি শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রত্যেকটি স্তরের মান আলাদা আলাদা মর্যাদায় অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রের।
নাগরিক হিসেবে নাগরিকদের কর্তব্য হলো দেশের সুখ্যাতি, সুশান্তি এবং দেশের মান বয়ে আনতে নিজেকে প্রস্তুত করা ও দক্ষতা বাড়ানোর স্তরে পরিশ্রম করা। শিক্ষা, চিকিত্সা, অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান নাগরিকের মৌলিক অধিকার। একজন নাগরিকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মৌলিক অধিকারের বাইরেও আরো কয়েকটি অধিকার রয়েছে। যা স্বাধীনভাবে প্রতিটি নাগরিকের থাকা প্রয়োজন। যেমন নির্বাচনের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, আইনের চোখে সবার সমান অধিকার, নিরাপত্তা লাভের অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার। প্রথমে আসি নির্বাচনের অধিকার নিয়ে। একজন নাগরিক যদি তার পছন্দের যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে এই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হবে। এই বঞ্চনা থেকে সৃষ্টি হবে বর্বরতা, বিশৃঙ্খলা এবং খুনখারাপিসহ নানান অশান্তিজনিত কার্যক্রম। নাগরিকদের ভোটাধিকার না থাকলে দেশে তো এমনিতেই দ্বিমত সৃষ্টি হবে, সৃষ্টি হবে নতুন ঝগড়াবিবাদ।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’। নাগরিকদের দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে কাগজে-কলমে, মুখে ও স্লোগানে, মিছিল-মিটিং-এ গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ্য থাকলেও বাস্তবে তা কতটা আছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমানে অনেক মানুষ আছে, যারা ভোটার হওয়ার ১০/১৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেনি। তরুণ এই প্রজন্ম বিক্ষুব্ধ। এ কারণে তাদের নিজের প্রতি, দেশের প্রতি এবং দেশের শাসনব্যবস্থার প্রতি একপ্রকার ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। দেশ উন্নত, ডিজিটাল এবং স্মার্ট হলেও বর্বরতা, মূর্খতা এবং অসভ্যতার দিক থেকে আমরা এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমার দেখা একটি নির্বাচনের কথা এখনো সুস্পষ্ট মনে আছে। তখন বুঝেছি, ব্যক্তি তার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কষ্টের তীব্রতা কতটা কঠিন। জনগণ যাকে উত্কৃষ্ট মনে করবে তাকেই তো ভোট দেবে। জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতা লাভের পর দেখা যায় কোথায় দেশ কোথায় জাতি! অথচ প্রকৃত ভোটের মাধ্যমে যেই জয়লাভ করবে সেই হবে জাতির মুকুট স্বরূপ। জাতির মূল মস্তিষ্ক হলো জনগণ। মস্তিষ্ক ছাড়া যেমন দেহ চলে না, তেমনি জনগণ ছাড়াও দেশ চলে না।
নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকারও ক্ষুণ্ন হচ্ছে কোথাও কোথাও। যা তাকে বলতেই হবে, তা না বলতে পারলে, নিজের বিবেকের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হবে। স্বাধীনতার চেতনায় জাগ্রত হওয়া জাতি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে জানে না। সময়ের কালগ্রাসের নিকৃষ্ট আবরণ তাদেরকে চুপ করিয়ে দিতে পারে সাময়িক সময়ের জন্য, চিরদিনের জন্য নয়। দেশের সুশাসন বৃদ্ধি করতে হলে পুনরায় সজীব প্রাণে উজ্জীবিত চেতনা ফিরিয়ে দিতে হবে, ফিরিয়ে দিতে জাতিসত্তার মূল মস্তিষ্কের তেজস্ক্রিয় অক্সিজেন এবং জনগণের প্রাপ্ত অধিকার। সুশাসন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের আইনি শাসনব্যবস্থা সকলের জন্য সমান হতে হবে। ধনী-গরিব, জাতি বর্ণভেদে রাষ্ট্রের আইন সব মানুষের জন্য সমান অধিকার সঞ্চালনা করবে, পরিচালনা করবে একটি শৃঙ্খলাময় সুশাসনে নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও দেশ। জাতিসত্তার মস্তিষ্ককে আঘাত করে জাতির মধ্যে সুশাসন কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
একটি দেশের সুশাসন বৃদ্ধি করার অন্যতম অংশীদার হলো সে দেশের আইনি শাসনব্যবস্থা। যা সফলভাবে সব মানুষের জন্য সূক্ষ্ম শপথে কাজ করে যাবে। বর্তমানে আমাদের দেশে আইনি শাসনব্যবস্থা তেমনটা সন্তুষ্টজনক নয়। পক্ষপাতিত্বের কারণে মানুষ এখন আইনি শাসনব্যবস্থাকে বহুলাংশে ভিন্ন চোখে দেখে। নাগরিক জীবনের হতাশা, সমস্যা ও বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক জটিলতার সম্মুখীন হলে দেশের আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে তা সহজে সমাধান করা সম্ভব। নাগরিকতার মূল্যয়ন এবং নাগরিক জীবনের অধিকার প্রদান করার মাধ্যমে দেশে সাবলীলতা ফিরে আসে, ফিরে আসে সুশান্তি, শৃঙ্খলা। আমরা কামনা করি, দেশ ফিরে আসুক তার স্মার্ট হওয়ার বাস্তব আসনে। রক্ষিত হোক জনজীবনের অধিকারসমূহ ।