গত ৮ই মার্চ পালিত হলো বিশ্ব নারী দিবস। এই বিশ্ব নারী দিবসে অনেকেই তাদের প্রিয় নারী, কন্যা, মা, বোনের প্রশংসা করতে ব্যস্ত থাকেন। বেশির ভাগই সেই প্রিয় নারীদের মনের খবর রাখার চেষ্টা করেন না। অধিকাংশ মানুষই এটা মনেই করেন না যে, তার প্রিয় নারীটি কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে পারেন। কেনই-বা ভোগেন কেউ কেউ সেটাও বুঝতে চান না। নারীদের একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। তাদের বাসাবাড়ি ও অফিস সামলানো থেকে বাচ্চা ও পরিবারের সদস্যদের যত্নসহ সব কাজ একহাতেই করতে হয়। তবে তারা সব সময় অবহেলিতই থাকেন। এখনো মেয়ে শিশুর জন্ম হলে বাবা-মায়েদের মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। আর গ্রাম অঞ্চলে মেয়ে শিশু মানেই বাড়তি বোঝা। কারণ তার জন্ম নেওয়ার পর পর তার যৌতুকের জন্য টাকা জমানো শুরু করতে হয়।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ২০১৮-২০১৯ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে যে জরিপ হয়েছিল সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ১৬.৮ শতাংশ মানসিক সমস্যার প্রাদুর্ভাব পাওয়া গিয়েছিল। শুধু নারীদের মধ্যে মানসিক সমস্যার হার পাওয়া গিয়েছিল ১৭ শতাংশ যেখানে পুরুষদের মধ্যে এ হার ছিল ১৬.৭ শতাংশ। আর করোনা ভাইরাস-পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।
ঝুঁকির কারণ :মানসিক ব্যাধিগুলোতে নারীদের ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে :একজন কন্যাসন্তান হিসেবে জন্ম নেওয়া, নারীদের পিরিয়ড, গর্ভধারণ প্রসবোত্তর অবস্থা ও মাতৃত্ব ইত্যাদি কারণে খুব বেশি হরমোনাল পরিবর্তন হয়, বাচ্চাদের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের যত্ন নিতে গিয়ে নিজের প্রতি উদাসীন থাকেন, নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম আয় করেন, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন ও অবহেলা, প্রায় তিন জনের মধ্যে এক জন নারী যৌনসহিংসতা, শারীরিক সহিংসতা এমনকি তাদের জীবদ্দশায় অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকে, নারীরা সঙ্গীর ভালো পরিচর্যা করলেও পুরুষদের কাছ থেকে কম যত্ন পান। সমাজ ও পরিবারের সদস্যরা নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নিচু মনোভাব পোষণ করেন। এমনকি বিভিন্ন শারীরিক রোগ থাইরয়েড সমস্যা, স্থূলতা ও ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি ইত্যাদি কারণে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। নারীদের মধ্যে যেসব মানসিক সমস্যা বেশি পাওয়া যায় সেগুলো হলো :
বিষণ্ণতা :কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে মন খারাপ বা কোনো কাজে উৎসাহ না পাওয়া হলো বিষণ্ণতার লক্ষণ, নিজেকে ছোট, গুরুত্বহীন মনে করা, ঘুমে সমস্যা, খাবার রুচির পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা, ওজনের পরিবর্তন, খিটখিটে মেজাজ, অস্থির বা চুপচাপ হয়ে যাওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা বা চেষ্টা ইত্যাদি বিষণ্ণতার অন্যতম প্রধান কিছু লক্ষণ। এই সমস্যাটি সারা বিশ্বেই মেয়েদের বেশি হয়।
প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা :হরমোনের তারতম্যের কারণে, মা হওয়ার পরে নারীদের একটু মন-মেজাজের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। এ সময় কিছু নারী, আরও অনেক মারাত্মক মনখারাপ অনুভব করেন, যাকে সাধারণত প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা বলে। এই ধরনের বিষণ্নতা সাধারণত শিশু প্রসবের কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস পরেও হতে পারে।
উদ্বিগ্নতাজনিত সমস্যা (অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার) :সব কিছু নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করা, প্রায় আতঙ্কিতবোধ করা (প্যানিক), অযথা ভয় পাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, মাথায় অস্বস্তি, গলার কাছে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি হওয়া, হাত-পা ঠাণ্ডা বা গরম হয়ে আসা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের উদ্বিগ্নতাজনিত সমস্যা, যা নারীদের মধ্যে বেশি হয়। সর্বশেষ জরিপে ৪.৮ শতাংশ নারীদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা পাওয়া যায়, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪.২ শতাংশ।
আত্মহত্যা :বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আত্মহত্যার সঙ্গে পারিবারিক নির্যাতন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। সর্বশেষ মানসিক স্বাস্থ্য (২০১৮-১৯) জরিপ অনুযায়ী ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এবং ১.৫ শতাংশ মানুষ একবার হলেও আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন। আর নারীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা পুরুষদের তিন গুণ।
মেয়েদের মনের যত্ন :নারী-পুরুষ সবারই মনের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিত পুরুষদের চেয়ে একটু আলাদা। তাদের মনে যত্ন নেওয়ার উপায়গুলো হলো :প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও মাইন্ডফুলনেন্স মেডিটেশন এবং ব্যায়াম করুন। নিজের স্বাস্থ্য, পুষ্টির ও ঘুমের দিকে মনোযোগ দেবেন। কারো কাছে কষ্ট পেয়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দিতে চেষ্টা করুন। আপনার কাজকর্মের সীমা বজায় রাখুন, প্রয়োজনে না বলুন এবং কাজের অতিরিক্ত বোঝা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আধঘণ্টা নিজের আবেগ অনুভূতি ও কল্পনাগুলো লিখুন। অন্যসময় এসব আসলে মনকে বলুন নির্দিষ্ট সময়ে এসব নিয়ে ভাববেন। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে নিজের আবেগ-অনুভূতি শেয়ার করুন। চরম মানসিক চাপ দুই-তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী থাকলে মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকোলজিস্টের সহায়তা নিন। এ সময় অনলাইনেও সহায়তা নিতে পারেন।