যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জড়ো হচ্ছেন গোটা বিশ্বের নেতারা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন তারা। স্বভাবতই বিশ্বের নজর এখন অনুষ্ঠিতব্য ইউএনজিএ সামিটের ওপর।
শুরুতেই বলে রাখা দরকার, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বরাবরের মতোই উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভাসবেন বিশ্বনেতৃত্ব। সভামঞ্চে বসবে বক্তৃতার আসর। এবং সবশেষে ‘বিশ্বের জন্য শান্তির বাণী’ শোনা যাবে জাতিসংঘের ঘোষণায়।
বাস্তবিক অর্থে, এমন এক সময়ে ইউএনজিএর অধিবেশন বসছে, যখন বিশ্ব জুড়ে বিরাজ করছে একধরনের ‘ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা’। আর এই উত্তেজনাকে বহুগুণে উসকে দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, যার উত্তাপ বয়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজার থেকে শুরু করে জ্বালানি, স্বাস্থ্য ব্যয়সহ বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রকে মাশুল দিতে হচ্ছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে।
সন্দেহ নেই, সাধারণ পরিষদের এবারের শীর্ষ সম্মেলনের সফল আয়োজন জাতিসংঘের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে। এর কারণ, বিশ্ব পার করছে এক অস্থির ও কঠিন সময়। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, লিবিয়ায় প্রাণঘাতী বন্যা, আফ্রিকা মহাদেশে একাধিক অভ্যুত্থানের ঘটনা, উত্তর বনাম দক্ষিণ অর্থনৈতিক তহবিলের (ইকোনমিক ফান্ডিং) প্রশ্ন, হাইতির সহিংসতা-সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন—এ রকম বহু সংকট গ্রাস করছে আজকের বিশ্বকে। এসব সমস্যার উত্তরণের পথটাও যেন অজানা হয়ে পড়ছে ক্রমশ!
বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয়, এবারের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনই অধিবেশনে অংশ নেবেন। অর্থাত্, এই সামিটের প্রভাবকে তেমন একটা তাত্পর্যপূর্ণ হিসেবে দেখার সুযোগ কম! এই দাবির পক্ষে আরো যুক্তি আছে। অধিবেশনের মঞ্চে দেখা যাবে না ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁকে। থাকছেন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গ্রেফতারের ঝুঁকিতে রয়েছেন বিধায় সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন না ইউক্রেনের মাটিতে যুদ্ধরত এই নেতা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে ইউএনজিএর সামিটে আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থাত্ থাকছেন না মহাপ্রতাবশালী এই নেতাও। এই যখন অবস্থা, তখন এবারের সামিটের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে স্বভাবতই। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে যদিও বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে কেবল একটি সদস্য উপস্থিত থাকা (যেহেতু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে এবারের সামিটে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিচ্ছে) ইউএনজিএর ইতিহাসে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়।
জানা গেছে, ১৪০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকবেন এবারের সম্মেলনে। ছয় জন ভাইস প্রেসিডেন্ট, চার উপপ্রধানমন্ত্রী ও ৩০ জনেরও বেশি প্রতিমন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে উড়ে যাবেন নিউ ইয়র্কে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের প্রধানদেরকেও দেখা যাবে আলোচনার টেবিলের আশপাশে। বিভিন্ন ইস্যুতে কণ্ঠ মিলিয়ে বক্তৃতা করতে দেখা যাবে বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসা নেতাদের।
সম্মেলন শুরুর প্রথম দিকেই সশরীরে যোগ দেবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাছাড়া বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ওয়াশিংটনে তিনি সাক্ষাত্ করবেন বলেও আশা করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের শীর্ষ সম্মেলনে স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কেবল একটিমাত্র সদস্যের (যুক্তরাষ্ট্র) উপস্থিত থাকা তথা প্রথম সারির বিশ্বনেতাদের প্রায় অধিকাংশের অনুপস্থিতির ফলে এবারের সামিট ঠিক কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনাকল্পনা। এতে করে জাতিসংঘের বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যকার বৈশ্বিক বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এবং বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতির যে সুযোগ, তাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুইস রাষ্ট্রদূত বেরিসউইল আগেই বলে রেখেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়তে পারে এর ফলে।’
বেরিসউইলের আহ্বান, ‘এই অবস্থায় বিশ্বের দেশগুলো যেন রাজনীতির শিকারে পরিণত কিংবা বিভ্রান্ত না হয়, তার জন্য কাজ করতে পারে অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো’। প্যাস্কেল বেরিসউইল মনে করেন, ‘সম্মেলন ঘিরে যেসব আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে মানবাধিকারকে রাখতে হবে সামনের কাতারে।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘আসছে সপ্তাহটি বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, ছোট দেশগুলোর জন্য সময়টা মহাসুযোগ। এবং দেশগুলো তাদের বিশেষ অগ্রাধিকারকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে খুব ভালোমতো।’ থমাস-গ্রিনফিল্ড শেষ করেছেন এই বলে, ‘আমি সপ্তাহটিকে বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখছি না আদৌ।’
যে যা-ই বলুন না কেন, নিরাপত্তা পরিষদের টেবিলে ‘ইউক্রেন প্রশ্নে বিশেষ কোনো বৈঠক বসলে তার জন্য রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে জেলেনস্কিকে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং রাশিয়া, ইউক্রেন ও তুরস্কের সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেলেনস্কি কী কথাবার্তা তুলবেন, সে সম্পর্কেও আগে থেকে চিন্তাভাবনা করে রাখতে হবে তাকে।
রাশিয়াকে কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তিতে (ব্ল্যাক সি গ্রেইন ডিল) ফিরিয়ে আনতে চায় জাতিসংঘ। তবে এ নিয়ে কথাবার্তা উঠবে কি না, তা নিশ্চিত নয় এখন পর্যন্ত। গত সপ্তাহে গুতেরেস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অপব্যবহার করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ মজার ব্যাপার হলো, এই কথার বিপরীতে নিরাপত্তা পরিষদের এক কূটনীতিক ইতিমধ্যে আওয়াজ তুলেছেন, ‘প্রতিবেশী ইউক্রেনকে আক্রমণ করে রাশিয়া ইতিমধ্যেই জাতিসংঘ সনদ (ইউএন চার্টার) পদদলিত করেছে। এর বিচার তাহলে কী হবে?’
এবারের সম্মেলনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে তথা দারিদ্র্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো বিষয়ে উন্নতির জন্য যে ১৭টি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা-বক্তৃতা হবে। সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এক রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে পরিমাণ তহবিলের প্রয়োজন, তার মাত্র ১৫ শতাংশ রয়েছে আমাদের হাতে। অর্থাত্, এসডিজি তহবিল বৃদ্ধির বিষয়ে ভাবতে হবে।’
দুঃখজনক হলেও সত্য, অন্য সময়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রবেশের অনুমতি মিললেও শীর্ষ সম্মেলনের সময়কার চিত্র থাকে একদম ভিন্ন—সপ্তাহব্যাপী ভেতরে ঢোকা বারণ! এটা স্বাভাবিক বিষয় বটে। তবে এতে করে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের বেশ বেগ পেতে হয়! তারা কেবল বাইরে দাঁড়িয়ে দাবিদাওয়ার বিষয়ে চিত্কার করার সুযোগ পায়। এবং ব্যানার-ফেস্টুন দোলাতে পারে মাত্র! যেহেতু জাতিসংঘের কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকে বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ জোটে না তাদের, কাজেই তারা যেসব সমস্যার কথা বলতে ছুটে আসেন, তা পৌঁছায় না বিশ্বনেতৃত্বের কর্ণকুহর পর্যন্ত!
অন্য চিত্রও আছে! ইউএনজিএর শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চে প্রায় প্রতিবারই দেখা যায় বিশেষ তারকাদের। তারা আসেন আসর মাতাতে! এবারও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটছে না। এই বিচারে অনেকেই বলছেন, ইউএনজিএর সম্মেলন ক্রমশ ‘অভিজাত শ্রেণির মিলনস্থল’ হয়ে উঠছে! এক্ষেত্রে যতটা না গুরুত্ব পাচ্ছে কূটনৈতিক আলোচনা, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘অন্য কিছু’। এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে চলে কেবল সভা-আলোচনা আর তর্কবিতর্ক! অথচ বৈশ্বিক সংকটের তালিকা দিনদিন লম্বা হতে থাকলেও তা থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণে জুতসই আলোচনা কার্যত চোখে পড়ে না!