করোনা মহামারির সময় থেকে শুরু করে চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট ও দেশের বাজারে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে দেশের সর্বশ্রেণির মানুষ। এই সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে দেশের ধনী শ্রেণি সেটা সামাল দিয়ে উঠতে পারলেও নিম্ন আয়ের মানুষ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের পরিধি না বাড়লেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ক্রমাগত ক্রয়সীমা অতিক্রম করেছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আহাজারি। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে না পেরে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষ বর্তমানে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে ব্যাপকভাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে গড়ে ২ দশমিক ১৮৬ ক্যালোরি হলে যথেষ্ট। কিন্তু বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে সিংহভাগ নিম্ন আয়ের মানুষই খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এনেছেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে—নিম্ন আয়ের মানুষ কী খেতে পারছে? তাদের বর্তমান খাদ্য তালিকায় কী রয়েছে? দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান কি নিশ্চিত হচ্ছে এই খাদ্য তালিকা থেকে? আয়-ব্যায়ের ব্যাপক এই অসামঞ্জস্য তারা কীভাবে সামাল দিচ্ছেন?
সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ’ নামের এক জরিপে উঠে এসেছে বেশ কিছু তথ্য, যা দেশের ১হাজার ৬০০ খানার নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আটটি বিভাগীয় জেলা ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে উঠে এসেছে, নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্যাভ্যাসে এনেছে বড় পরিবর্তন। আয়ের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে করতে হচ্ছে সংকোচন। সানেম শহর এবং গ্রামের প্রায় ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর করা জরিপে উঠে এসেছে এমন তথ্য। জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ খাদ্যের পরিমাণ কমিয়েছে ৯০ দশমিক ০২ শতাংশ সাধারণ মানুষ। অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে ধার করছে ৭৩ দশমিক ০৮ শতাংশ মানুষ। নন ফুড কমিয়েছে ৫৫ দশমিক ০৯ শতাংশ মানুষ। আয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করা হতো, সেটা কমিয়েছে ৫৫ দমমিক ০৫ শতাংশ মানুষ। ব্যয় মেটাতে নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও ওভারটাইম বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করছে ৩৯ দশমিক ০৩ শতাংশ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে গ্রাম অঞ্চলের মানুষ থেকে শহরের মানুষ খাদ্যে বড় পরিবর্তন এনেছে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে খরচ পরিবর্তন এনেছে বেশি। যেমন, যেসব পরিবার মাসে চার বার মুরগি খেত, তারা এখন খাচ্ছে দুই বার। মাসে ডিম খেত ৮ দশমিক ১ বার, তারা খাচ্ছে ৫ দশমিক ৮ বার। ইলিশ মাছ খেত তিন বার, তারা এখন খাচ্ছে এক বার। এছাড়াও রুই/কাতলা মাছ খেত ৬ দশমিক ৩ বার, তারা এখন খাচ্ছে ৪ দশমিক ৩ বার। গরুর মাংস ছয় মাস আগে খেত ১ শতাংশ মানুষ, এখন খাচ্ছে ০ দশমিক ৩ শতাংশ। খাসির মাংস ছয় মাস আগে ছিল ০ দশমিক ২ শতাংশ, এখন ০ দশমিক ১ শতাংশ।
উক্ত জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করলে আমরা অনুধাবন করতে পারি, দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যেখানে দেশের অসংখ্য মানুষ খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছেন। এছাড়াও দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা তুলনামূলক কম। এরই মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেক নিম্ন আয়ের পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে চলছেন। জীবন যাপনের খরচ মিটিয়ে বর্তমানে তাদের পক্ষে সঞ্চয় করার বিষয়টি কঠিনতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে অচিরেই দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ বৃহত্তর সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পড়বে। ব্যাপকভাবে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে, ফলে দেশের বৃহৎ একটা অংশ পুষ্টিসংকটে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ২০১৬ সালে ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এখন ২০২৩ সালের সপ্তম মাস চলছে,আর ১০ বছর সময়ও আমাদের হাতে নেই। এই সময়ের মধ্যে কি বর্তমান পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে? তাই দেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা যথাযথ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে দেশের এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যেতে পারে।