পরিযায়ী পাখি বলতে বোঝায়—যারা পরিভ্রমণ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়, আবার পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। প্রতি বছর শীতকালে আমাদের দেশে হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের অঞ্চল, উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। বর্ষার শেষে এবং শীতের শুরুতে এসব পাখি আসতে শুরু করে। আবার মার্চের শেষ দিকে বা বসন্তকালে যখন এই অঞ্চলের দিকে গরম পড়তে শুরু করে এবং শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলাও শুরু হয়, তখন পাখিগুলো নিজ এলাকায় ফেরত যায়। পাখিগুলো যেসব দেশ থেকে আসে, সেখানে প্রচণ্ড শীত থাকে। শীতে তুষারপাতের কারণে পাখিদের বিচরণক্ষেত্র ঢেকে যায় বলে নতুন গাছপালা জন্মাতে পারে না, খাদ্যের সংকট তৈরি হয়। মূলত খাবারের সন্ধানে, প্রজনন ও ছানাদের লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের খোঁজে পাখিরা পরিযায়ী হয়।
বাংলাদেশের মতো কম ঠান্ডার অঞ্চলে পাখিদের জীবনধারণের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ও পর্যাপ্ত খাবারের জোগান থাকে। এজন্য প্রতি বছর শীতের সময় টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওরসহ বিভিন্ন হাওরাঞ্চল, খাল ও নদীর চর এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিল-জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক দেখা যায়। ঢাকা শহরের ভেতরে মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার লেক ও শহরের অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পাখি আছে, যার এক-তৃতীয়াংশই পরিযায়ী। বাংলাদেশে সাত শতাধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী। এদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও বনায়ন সৃষ্টিতে পরিযায়ী পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এদের মল ত্যাগের ফলে এবং ঠোঁটে বীজ বহন করে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে বনায়নের সম্ভব হয়। এরা ফুল-শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, জমির ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করে কৃষকের উপকার করে কৃষি অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। এরা পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। এদের বিষ্ঠা জমির উর্বরাশক্তি বাড়ায়, আবার এই বিষ্ঠা পানিতে মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, জলাভূমির দখল, হাওড়-বাওরে ব্যাপক হারে মাছ শিকার, রাসায়নিক বর্জ্য ও কীটনাশকের প্রভাবে পানিদূষণ, বৈশ্বিক উঞ্চতার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন, চোরা শিকারি কর্তৃক ব্যাপক হারে পাখি শিকার ও পাচার, নতুন জেগে ওঠা চরে মানব বসতির বিস্তার ও কৃষি জমির সম্প্রসারণের কারণে পাখির বিচরণক্ষেত্র কমে বিগত বছরের চেয়ে এদের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় শিকারিরা ফাঁদ ও কারেন্ট জাল দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে শিকার করে পরিযায়ীদের। শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রতি বছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাখি যখন কোনো একটা এলাকাকে তার জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করে, তখন সেই এলাকা তারা এড়িয়ে চলে। এভাবে প্রতি বছর আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
শীতের মৌসুমে বনভোজন, শখ মেটাতে বা স্পোর্টস হিসেবে অনেকেই পাখি শিকার করেন। একটা পাখিকে হত্যা করা যে অন্যায়, সেই শিক্ষা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিতে হবে। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের ২৬ ধারামতে পাখি শিকার ও হত্যা দণ্ডনীয় অপরাধ। যার সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কেউ কেউ যুক্তি দেয়, পরিযায়ী পাখি এ দেশের নয়, তাই শিকারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এক্ষেত্রে জেনে রাখতে হবে, এসব পাখি কোনো দেশের একক সম্পদ নয়, এদের আন্তর্জাতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে এরা সব দেশেই স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। সর্বোপরি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য পরিযায়ী পাখির নিরাপত্তাদানে আমাদের প্রাণবিক হতে হবে।