জোরপূর্বক শ্লীলতাহানি মেয়েদের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। আপনি যদি নারী হন এবং অনেক নিরাপত্তাবেষ্টিত হন, তার পরও আপনাকে পুরো জীবনে কখনো না কখনো পুরুষের খারাপ দৃষ্টি, অযাচিত স্পর্শের বা খারাপ আচরণের সম্মুখীন হতে হবে। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এক সূত্রে ২০২২ সালে ৭৩৫টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ধর্ষণচেষ্টার পরিসংখ্যান যদিও নেই। এটা এমন না যে নারী চাইলেই এড়াতে পারে। নারীর নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরেই যদি থাকে গলদ, সেখানে ভয় পেতে হবে। নারীদের সাহস ততটুকুই রাখা উচিত, যতটুকু থাকলে তার নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হবে না।
মনে রাখবেন, নারী যেমন এই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তেমন পুরুষকে বাদ দিয়েও এই সমাজ অচল। নারী ও পুরুষ উভয়েই একটা সমাজের মূল শক্তি হতে পারে, যদি তারা নৈতিক মূল্যবোধ ও জ্ঞানসম্পন্ন হয়। ‘ধর্ষণ’ শব্দটা আমাদের সমাজে অনেক বেশি প্রচলিত—এ কারণে যে, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারীর ধর্ষিত হওয়ার খবর শোনা যায়। প্রতিনিয়ত রেডিও, টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ষণের, ধর্ষণচেষ্টার খবর শোনা যায়।
নারীর অধিকার নিয়ে আমরা সবাই কথা বলি। নারী আসলে কতটা সচেতন? নারীকে দেওয়া নিরাপত্তা আসলে কতটা কার্যকর? নারী অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী চর্চা কম হচ্ছে না। পুরুষের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবে না, কারণ তাদের জন্ম থেকে বলশালী মনে করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারীর কলঙ্কের ভয় আছে, যেটা পুরুষের নেই। মেডিক্যালের ভাষায় বলতে গেলে নারীর ভার্জিনিটি সহজেই চেক করা যায়, কিন্তু একজন পুরুষ ভার্জিন কি না, তা করা যায় না। অন্যদিকে এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষ হবে রাম আর স্ত্রী হবে সতীলক্ষ্মী সীতা। সীতা অপবিত্র না হলেও বনবাসে যেতে হয়েছে। নারীর ঘরে-বাইরে প্রতিনিয়ত নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নিয়ে যেন জন্মানো উচিত। কারণ ঘরে বা বাইরে কোথাও সে নিরাপদ নয়। ছোট থেকেই মেয়েরা দূর সম্পর্কের আত্মীয় তথাকথিত মামা, চাচা, খালু, কাজিনদের কাছে অনিরাপদ। অতি রক্ষণশীল পিতা-মাতার কারণে যদিবা তারা এদের হাত থেকে রক্ষা পায়, কিন্তু গণপরিবহনে অযাচিত স্পর্শ, অঙ্গভঙ্গির বিকৃত প্রদর্শন—এসব যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। হাজারো মেয়ে প্রতিনিয়ত লালসার শিকার হচ্ছে। কখনো নারীরা তাদের বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এসব পরিস্থিতি সামলে নিলেও ধর্ষণচেষ্টাকারীর শাস্তি হচ্ছে কোথায়?
সম্প্রতি শোনা এক খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ধর্ষণচেষ্টাকারীর শাস্তি ১০ বার কান ধরে ওঠবস’। এই যদি হয় এমন নিকৃষ্ট আচরণের শাস্তি, তাহলে এই অপরাধ কমবে না, বরং দিনে দিনে বাড়বে। বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রণীত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-এর ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯ (১) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এত দিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে বা আহত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ডের বিধানও ছিল। সেই আইনের পরিবর্তন এনে সংশোধন করে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি যেমন মৃত্যুদণ্ড, তেমনি ধর্ষণচেষ্টার শাস্তিও কঠিন হওয়া উচিত। দু-একটি দৃষ্টান্ত মানুষের চোখে পড়লে পরবর্তী সময়ে যে কেউ ধর্ষণের মতো অপরাধ করার আগে শতবার ভাববে।
সর্বোপরি, একজন নারী হিসেবে আমার নিরাপত্তার জন্য আমাকেই সোচ্চার হতে হবে। ধর্ষণমুক্ত একটি সমাজ বিনির্মাণে নারী-পুরুষ উভয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। একজন বাবা হিসেবে যেন পুরুষ ভাবতে পারে আমার কন্যা যেমন আমার কাছে নিরাপদ, অন্যের কন্যাও সমান নিরাপদ।