সুধীর বরণ মাঝি
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর:-
নির্বাচন দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য, দেশের উন্নয়ন ও উন্নতির জন্য। তাই নির্বাচনে নানান মত থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
দ্বাদশ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচনী সহিংসতার খবর, ছবি এবং ভিডিও ক্লিপ আমরা দেখতে পাই, আন্তর্জাতিক, জাতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর এই সংবাদ ছবি এবং ভিডিও ক্লিপ আমাদেরকে আহত করে, ভীত করে। নির্বাচন পরবর্তী কিংবা নির্বাচনকালীন সময়ে যে সহিংসতাগুলো ঘটে এবং যারা হতাহতের স্বীকার হয় তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সেই সাথে আমাদের কারো না কারো আত্মীয়। এই সহিংতাগুলো আমাদের জন্য ভালো কিছু বার্তা বহন করে না । এতে পরস্পরের প্রতি হিংসা, ঘৃণা বৃদ্ধি পায় চরমভাবে। সম্প্রীতি ধ্বংস হয়।
নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার যে অপসংস্কৃতি আমাদের দেশে দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলমান রয়েছে তা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলো। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র সম্ভবত আমাদের দেশ বাংলাদেশে জনগণের সেবা, দেশের উন্নয়ন করার জন্য এবং উন্নয়ন করার ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, জ্বালা-পোঁড়াও, লুটপাট, দোকানপাট- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, বড়িঘর-জায়গা জমি ও সম্পত্তি দখলের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এমনকি ফসলের ক্ষতিও করা হয়।
মানসিকভাবে সৃষ্ট প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে প্রায় সময় মিথ্যে মামলার আশ্রয় নেওয়া হয়। যা আমরা জাতীয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
প্রত্যক্ষ করি। যা আমাদেরকে লজ্জা এবং ঘৃণার রাজটিকা এঁকে দেয়। এই বোধদ্বয় জাগ্রত হওয়া জরুরী। নির্বাচনের পর এমন সহিংসতা স্বভাবতই উদ্বেগজনক। বস্তুত দেশে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনী সিহংসতা সরকার এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিশ্বের কাছে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি হিসাবে পরিচিত।
নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ক্ষত সহজেই শুকায় না। এই সহিংসতা পারস্পারিক শত্রুতা সৃষ্টি হয়। নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকার ওপরে ছাড়িয়ে যায় এবং সেই সাথে কিছু স্থায়ী ক্ষতিও আছে।
নির্বাচনী সহিংসতায় সবচেয়ে আক্রমণের স্বীকার হয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। নির্বাচনে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা অনেকটা অহিনকুল-র মতো। অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় অনেকে নিহত হয়েছেন, শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, অনেকের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সেসব ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি, বরং রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের সহিংসতার কারণ রাজনৈতিক নয় বলে প্রচার করেছে। তারা একে সামাজিক, গোষ্ঠীগত এবং পরস্পর সম্পর্কছেদের কারণ হিসাবে অভিহিত করেছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের পর দেখা যায়, প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের জন্য বিজয়ী দল এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একটি নির্বাচনের ফলে সরকারে কোনও পরিবর্তন হলে তা প্রভাবিত করতে পারে সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান। নির্বাচনী সহিংসতার কারণে অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। নির্বাচনী সহিংসতার কারণে অনেক সংখ্যলঘু হিন্দু পরিবার বাঁচার জন্য পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। যা আমাদের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় এবং ভাবনার বিষয় আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার পরিমাণ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক একই হারে উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দু জনসংখ্যা। অন্যান্য সময়ের নির্বাচনের সহিংসতার মতো এবারের নির্বাচনী সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করা হয়, তাদের বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়, মাছের ঘেরসহ অন্যান্য সম্পত্তি দখল করে নেওয়া হয়েছে এবং হত্যাও করা হয়েছে।
নির্বাচনের পর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেন কোনোরকম হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার না হন, সেদিকে প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যারা সরকার গঠন করবেন, তাদেরও বুঝতে হবে যে তারা যখন সরকার গঠন করেন, তখন সেটা রাষ্ট্রের সরকার হিসাবে বিবেচিত হয়, নির্দিষ্ট কোনো দলের নয়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায়। তাই এ ধরনের অপরাধ দমনে সরকারকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচন পরবর্তী হিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবেন তিনি। নির্বাচনের সহিংসতায় নির্বাচিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার নির্বাচিত বাতিল করতে হবে এবং আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে নির্বাচনী সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করে দেশের সাধারণ জনগণ। নির্বাচনী সহিংসতা রোধ করতে সরকারকে আরো কঠোর হওয়া, দোষীদের বিচার নিশ্চিৎ করা, দায়িত্বশীল, রাজনৈতিক সহমর্মিতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ করার পাশপাশি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনী সহিংসতা রোধ করতে পারবো।
নির্বাচনি সহিংসতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা শুধু দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই নয়, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্যও প্রয়োজন। নতুন সরকার নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার লাগাম টানতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য। মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোনো সহিসংতাই নিন্দনীয়। সহনশীল আচরণ তো বটেই, জয়-পরাজয় স্বীকার করে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রেখে নির্বাচনী সহিংসতার অপসংস্কৃতি থেকে সকল দলের নেতাকর্মীরা বেড়িয়ে আসবেন, অসম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গেড়ে তোলার প্রত্যয়ে সবাই হাতে হাত রেখে গিয়ে আসবেন এটাই প্রত্যাশা।