মূল্যস্ফীতি সাধারণত দুইভাবে হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি সরবরাহের দিক থেকে, অন্যটি চাহিদার দিক থেকে হয়। আমরা বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে যে মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছি, তা বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সরবরাহের দিক থেকেই হচ্ছে। অর্থাৎ, বর্তমান মূল্যস্ফীতি শুধু অভ্যন্তরীণ সরবরাহের কারণে যেমন হয়নি, তেমনি শুধু বৈশ্বিক সরবরাহের কারণেও হয়নি। স্থানীয় ও বিদেশি উভয় কারণেই মূল্যস্ফীতির অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বর্তমানে যে মাত্রায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তা বিগত ৪০ বছরের মধ্যে আর কখনোই দেখা যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি একপর্যায়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তার পরও কোনো কোনো পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরেই মার্কিন ডলারের সংকটে ভুগছে। মার্কিন ডলারের সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদেশ থেকে আমদানি করা যাচ্ছে না। আর আমদানি যদি কম হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়বেই। হয়তো কোনো পণ্য আমার প্রয়োজন ১০টি, কিন্তু আমি আনতে পারছি বা আনছি পাঁচটি। তাহলে বাজারে সেই পণ্যের সংকট দেখা দেবে। পণ্যটির ব্যাপক চাহিদার কারণে দাম বাড়বে। যেমন বর্তমানে চিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হচ্ছে না, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদামতো চিনির জোগান দিতে না পারায় বাজারে চিনির দাম বাড়ছে। রমজান মাসে চিনির চাহিদা আরো বাড়বে।
গমও পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হচ্ছে না। ফলে এসব পণ্যের চাহিদা ও দাম বাড়ছে। চিনি বা গম যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হতো, তাহলে এ দুটি পণ্যের দাম এতটা বাড়ত না। বাইরে থেকে যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না, তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও কোনো কোনো পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে। যেমন—গত বছর দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যা হওয়ার কারণে বোরো ধানের ফলন খুব একটা ভালো হয়নি। বোরোর উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ার কারণে দাম বেড়েছে। বাজারে খাদ্যপণ্যের বর্ধিত মূল্যই রয়ে গেছে। এবার আমনের ফলন কিছুটা ভালো হওয়ার কারণে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আর বাড়ছে না। কিন্তু দাম ততটা কমছেও না। বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম এখনো উচ্চপর্যায়েই রয়েছে। আগামীর দিনে বোরো ধানের ফলন যদি ভালো হয়, তাহলে বাজারে চালের দাম হয়তো বেশ কিছুটা কমে আসবে। আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা আর কমে না। খাদ্যপণ্যের দামও হয়তো আগামী দিনে খুব একটা কমবে না। বর্তমানে মূল্যস্তর যেখানে আছে, সেখানেই হয়তো স্থিতিশীল থাকবে। আর বেশি বাড়বে না।
অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়ার আর একটি কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়ে। বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানিনির্ভর একটি দেশ। জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমাদের আমদানি করতে হয়। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দামের ওঠানামার ওপর অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম প্রভাবিত হয়। ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে সব ধরনের পরিবহন ভাড়া এবং জমিতে পানি সেচের খরচ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব তাত্ক্ষণিকভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারে পড়ে। এটা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে সব দেশে। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়লেও অভ্যন্তরীণ বাজারে ভর্তুকি দিয়ে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভর্তুকি কমানোর জন্য তেলের দাম বাড়ানো হয়। এখন প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বাজারে দাম কমানো সম্ভব কি না? সরকার বলছে, এখনো তারা দিনে ২০০ কোটি টাকার ওপরে ভর্তুকি দিচ্ছে ডিজেলে। কাজেই আমার কাছে মনে হচ্ছে না যে অচিরেই অভ্যন্তরীণ বাজারে ডিজেলের দাম কমানো সম্ভব হবে। তবে এটা মোটামুটি বলা যেতে পারে, ডিজেলের দাম শিগিগরই বাড়ার আশঙ্কা কম। এই সুযোগে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাজারভিত্তিক করে ফেলতে পারে। সরকার জ্বালানি খাতে যে ভর্তুকি দেবে, তা দামের সঙ্গে যোগ করে দিতে পারে। এটা করা হলে জনগণও জানতে পারবে সরকার জ্বালানি খাতে কী পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে সরকার এমন উদ্যোগ নেবে কি নেবে না, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
যুদ্ধ চলমান থাকায় এখনো সে রকম কোনো ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি না যে, বিশ্বে বড় ধরনের কোনো সরবরাহের সংকট সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থা যে তথ্য প্রকাশ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ যুদ্ধ-পূর্বাবস্থায় চলে আসছে। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন যদি স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে, তাহলে মূল্যও আনুপাতিক হারে কমতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি না। হঠাৎ করে রাশিয়া যদি ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন খাদ্যপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করে। এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। কাজেই খাদ্যপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এমন কোনো পদক্ষেপ হয়তো রাশিয়া নেবে না। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন যদি স্বাভাবিকও থাকে, তাহলেও আমাদের কিছুটা বেশি দামে খাদ্যপণ্য কিনতে হবে। কারণ বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার অনেকটাই বেড়ে গেছে। কাজেই চাইলেই আমরা বাংলাদেশি টাকায় আর আগের মতো কম দামে খাদ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ করতে পারব না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে তিন বারে নীতি সুদহার ১ শতাংশ বাড়িয়েছে। আগে নীতি সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমি বলব, যত দিন ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারিত থাকবে, তত দিন নীতি সুদহার বাড়ানো হোক বা কমানো হোক, তাতে তেমন কিছু হবে না। অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। ভোক্তা পর্যায়ে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার তো ৯ শতাংশই রয়ে যাচ্ছে। কাজেই নীতি সুদহার বাড়ানোর কোনো প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে পড়ছে না। বিষয়টি এমন যে, আমরা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চাই, নাকি ব্যাংক ঋণের সুদের হার কম রেখে মুদ্রানীতি সহজীকরণ করে আপাতত কিছু প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই? আমি মনে করি, এক্ষেত্রে আমরা খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমার যে নীতি গ্রহণ করছি, তা দিয়ে বহির্বাণিজ্যকে স্থিতিশীল করতে পারছি না। মূল্যস্ফীতি আরো অনেক দিন চলতে থাকবে। আমরা যেভাবে টাকা ছাপাচ্ছি, তা-ও ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমি মনে করি, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার থেকে শুরু করে কোনো কিছুই সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া ঠিক নয়। বাজার চাহিদার ভিত্তিতেই প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত। যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়, তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার প্রত্যাহার করার পর যদি নীতি সুদহার বাড়ানো হতো, তাহলে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হতো। মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান বাড়ত, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা হলেও সহায়ক হতে পারত। ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ বজায় রেখে নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফার হার আগের তুলনায় কমে যাবে—এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
সামগ্রিকভাবে আমি বলব, আমাদের নীতি কৌশলে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে, যদি আমরা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে চাই। মূল বা হারকে বেঁধে রাখার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে এবং বাজারব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে হবে।