মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ, রাজনৈতিক প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত সম্পর্ক। তাহাদের অব্যাহত সম্পর্ক ৭৭ বত্সরের। এই সময়ের মধ্যে সম্পর্কের মাত্রাতিরিক্ত ঘাটতি হয় নাই কখনোই। ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলা অথবা সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সৌদি আরবের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আসিলেও সেই সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হয় নাই (টুইন টাওয়ার হামলাকারীদের বেশির ভাগই ছিল সৌদি নাগরিক এবং তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে জামাল খাশোগির নৃশংসভাবে নিহত হইবার ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত রহিয়াছে বলিয়া বিশ্বব্যাপী অভিযোগ আছে)। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন দখলের পর হইতে যেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক ওলটপালট হইতে শুরু করিয়াছে।
বিশেষ করিয়া, তেল উত্পাদনকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক প্লাস আগামী নভেম্বর মাসের শুরু হইতে প্রতিদিন ২০ লক্ষ ব্যারেল তেল উত্পাদন কমাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব সম্পর্ক যেন তলানিতে গিয়া ঠেকিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন এই সিদ্ধান্তের কারণে যাহার পর নাই ক্ষিপ্ত হইয়াছেন। খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলিয়াছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা হইবে। যদিও সৌদি আরব বলিয়াছে, ইহা ওপেকের সিদ্ধান্ত এবং সম্পূর্ণরূপে তেলের বাজারের কথা বিবেচনায় রাখিয়া ওপেক এই সিদ্ধান্ত নিয়াছে, ইহা শুধু সৌদি আরবের একার সিদ্ধান্ত নহে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাহা মনে করে না। যুক্তরাষ্ট্র বলিয়াছে, ইহা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে ইহা এমনকি সাধারণ্যের বুঝিতেও কষ্ট হইবে না যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষিপ্ত হইবার যৌক্তিক কারণ রহিয়াছে। বিশ্বে যখন তেলসংকট প্রকট হইতেছে তখন ওপেক প্লাসের তেল উত্পাদন কমাইবার কোনো যুক্তি থাকিতে পারে না। উপরন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সফর করিয়াছিলেন দুইটি উদ্দেশ্য লইয়া। একটি সৌদি আরব ইসরাইল ডিফেন্স প্যাক্ট, অন্যটি তেল উত্পাদন বৃদ্ধি করিতে অনুরোধ জানাইয়াছিলেন। কিন্তু উহা তখনই করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়াছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর হইতে বাইডেন যুবরাজ সালমানের সঙ্গে কথা বলিতেন না। পরবর্তীকালে বর্তমান সংকট শুরুর পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ৫০ শতাংশ তেল উত্পাদন বাড়াইবার আশ্বাস দিয়াছিল। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উত্পাদন কমাইবার প্রশ্নে রাগান্বিত হইয়াছেন।
ওপেক প্লাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যে প্রভাব পড়িতে পারে তাহা মোটেই সুখকর হইবে না। সৌদি আরব তাহার আধুনিক অস্ত্রের ৭৩ শতাংশ সরবরাহ পাইয়া থাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট হইতে। ইতিমধ্যেই জানা গিয়াছে, বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরব হইতে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান তুলিয়া লওয়া, সামরিক সহায়তা বন্ধ করা ও অস্ত্র বিক্রয় সীমিত করিবার কথা বিবেচনা করিতেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কর্মকর্তা ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হইয়াছে। মনে রাখিতে হইবে, সৌদি আরবের শত্রুর অভাব নাই। ইয়েমেনের হুতি গেরিলাদের সঙ্গে তাহারা যুদ্ধরত, পার্শ্ববর্তী আরেক শক্তিশালী দেশ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই বৈরী। এই রকম অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন তুলিয়া লইলে সৌদি আরব ভালনারেবল হইয়া উঠিতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্য আবারও অশান্ত হইয়া উঠিবার সম্ভবানা রহিয়াছে। অন্য দিকে সৌদিসহ ওপেকের এই তেল উত্পাদন কমাইবার সিদ্ধান্তটি শুধু ইউক্রেন যুদ্ধকেই প্রভাবিত করিবে না, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য আরো চড়াইয়া দেবে, যাহা সর্বাধিক ক্ষতি করিবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলিকে। তাই ওপেকের এই সিদ্ধান্ত উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলির বিরুদ্ধে অবস্থা গ্রহণের শামিল।