নৈতিক শিক্ষা ছাড়া আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। শিক্ষা অপূর্ণাঙ্গ হলে সে শিক্ষা সমাজ বা মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে না-পারাটাই স্বাভাবিক। যে শিক্ষা সফলতার মুখ দেখাতে পারে না, এমন শিক্ষা দেওয়া বা নেওয়ার মধ্যে কোনো সার্থকতা আছে বলে মনে করা যথার্থ নয়। যে কোনো শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে, অর্থাৎ শিক্ষার সুফল ভোগ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাব্যবস্থাকে জোরদার করা জরুরি। আদিকাল থেকেই শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে আসছেন। দৃশ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে নৈতিক শিক্ষাদানকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, মাদকসহ নানা কিছুর কুপ্রভাব থেকে সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাদানে শিক্ষকসমাজের আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করি।
এমন অনেক কাজ আছে, যা করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নীতিগত বাধা ও সামাজিক অসম্মতির কারণে আমরা তা করতে পারি না। এসব কাজই অনৈতিক কাজ বলে বিবেচিত। কোনো কাজ করার আগে উচিত-অনুচিত, সামাজিক ও নীতিগত সম্মতি-অসম্মতি বিবেচনা করে অনুচিত কাজ করা থেকে বিরত থাকা এবং উচিত কাজ করাকেই বলা হয় নৈতিকতা। নৈতিকতা সম্পর্কে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেন, ‘যে কাজটি করার পরে ভালো লাগবে, তা নৈতিক আর যে কাজ করার পরে খারাপ অনুভূতি হবে, তা অনৈতিক।’
কাজেই নৈতিক কাজে উত্সাহিত ও অনৈতিক কাজে নিরুত্সাহিত করতে যে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক, পুঁথিগত কিংবা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দেওয়া অতি জরুরি। নৈতিক শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা, যা মানুষকে উচিত-অনুচিত বুঝতে শেখায়, মানুষের বিবেককে জাগ্রত রাখে, মানুষকে শিষ্টাচার, শালীনতা ও শুদ্ধাচার শিক্ষা দেয়। নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতা মানুষের মধ্যে বিনয়, মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাশীলতা এবং পারস্পরিক সেতুবন্ধ সৃষ্টি করে। মানুষকে নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে উত্সাহিত করে এবং অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে। যার মধ্যে নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতা নেই, সে সমাজে একজন পূর্ণাঙ্গ বা সুশীল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। কোমলমতি শিশুদের নৈতিক শিক্ষা লাভের প্রথম এবং প্রধান প্রতিষ্ঠান তার নিজ পরিবার হলেও নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভূমিকা মোটেও কম নয়। শিক্ষককে নৈতিকতার আধার বা ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলেই শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলে অভিহিত করা হয়।
যে কোনো ধরনের শিক্ষা, পেশা, কর্ম এবং পরিকল্পনার সুফল ও সফলতা কোনো না কোনোভাবে নৈতিকতার ওপর নির্ভরশীল। নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতা মানুষকে মানবতাবাদী রূপে গড়ে তোলে।
নৈতিক শিক্ষা ব্যতিরেকে কোনো শিক্ষা সমাজকে আলোকিত করতে পারে না। সমাজে দৃশ্যমান অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানিসহ সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ কেবল নৈতিক শিক্ষা ও নৈতিকতার অভাবের ফল। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে মাদক-সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজ কলুষিত হয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা না দিলে আজকের যে শিক্ষার্থী আগামীর দিনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাবেন তাদের কাছ থেকে মানুষ, সমাজ, জাতি কোনো নিরাপদ ও সঠিক সেবা পাবেন না, বরং প্রতারিত হবেন।
কাজেই পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া একান্ত আবশ্যক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের তথা শিক্ষকসমাজের যথেষ্ট দায়বদ্ধতা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে কী করণীয়, কী বারণীয় তা সমাজকে বোঝাতে হবে। কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে নৈতিকতা বা নীতিবোধ শক্তিকে আরও সুচারু করে তোলার জন্য সম্মানিত শিক্ষকসমাজের কাছে থাকতে বিনীত অনুরোধ। শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিক শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তার ঘটিয়ে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ ও জাতি গঠনে আমাদের সম্মানিত ও গর্বিত শিক্ষকসমাজকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান রেখে বলছি—আসুন, আমরা শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি নৈতিক শিক্ষা দিই। অপরাধের অন্ধকার তাড়িয়ে সমাজকে পুণ্যের আলোয় আলোকিত করি। সুন্দর সমাজ ও উন্নত দেশ গড়ি।