১ জানুয়ারি ২০২৩ নতুন বছরের প্রথম সকালে একটি সংবাদে চোখ আটকে গেল। গত থার্টি ফার্স্ট নাইটে নিষিদ্ধ ঘোষিত ফানুসের দুই শতাধিক ব্যাগ বর্জ্যের টুকরা মেট্রোলাইনের বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে থাকায় ঢাকায় সবে চালু হওয়া মেট্রোরেল চলাচল দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল। বিষয়টি বেশ পীড়াদায়ক। কিন্তু আকাশে ফানুস উড়ানো তো শিল্পবিপ্লবের আশীর্বাদ।
মানুষ সেই আশীর্বাদ ধরে রাখতে আতশবাজিতে আনন্দে মাতোয়ারা হতে চাইতে পারে। বিশেষ দিনে ব্যাপক মাত্রায় ফুর্তি করার সময় সবাই যে সম্ভাব্য ক্ষতির কথা স্মরণ করতে ভালোবাসে না! থার্টি ফার্স্ট রাতে আতশবাজি, ফানুস ইত্যাদি ব্যবহার না করার জন্য গত কয়েক দিন ধরে বেশ প্রচারণা চলে আসছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আতশবাজি ও পটকা-বারুদ বিক্রির দোকান তো নিষিদ্ধ বা বন্ধ ঘোষিত হয়নি! রাত ১২টার পর ঢাকাসহ সারা দেশের আকাশে ভীষণ শব্দ ও বর্ণিল আলোর ঝলকানিতে মনে হচ্ছিল যে এটাও বাঙালির কোনো বড় উৎসব। সরকার কেন অযথা এসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? সারা পৃথিবীতে আলোর ঝলকানি দিয়ে ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। আমরাও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অফিশিয়াল কাজকর্ম চালাই। তবে আমাদের দেশে কেন বাধা দেওয়া হবে? এর কি কোনো কারণ রয়েছে?
হ্যাঁ, এর প্রধান কারণ, বড় অগ্নিকাণ্ডে এখনো আমাদের সবকিছু সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে শহরের উঁচু ভবনের অগ্নিকাণ্ডে আমাদের বড় সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটে থাকে। আমাদের সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে কর্তৃপক্ষ সতর্কতা জারি করলেও সভ্য মানুষগুলো সেটা অবহেলা করাকে স্মার্ট কাজ বলে মনে করে। সিংহভাগ মানুষের মধ্যে আইন না মানাটাই আমাদের স্মার্ট চিন্তার অংশ।
দুই দিন আগে এক সকালে মেট্রোরেলের স্টেশনে কলাপসিবল গেট বন্ধ দেখে অস্থির যাত্রীরা সেটা টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। এটা আমাদের দেশের মানুষের অস্থির চিত্তের পরিচয় বহন করে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা কর্মক্ষম জনমিতির সুযোগ দীর্ঘদিন ধরে কাজে না লাগানোর কারণে আমাদের বিরাট অংশের শিক্ষিত মানুষ বেকারত্বের কশাঘাতে ভুগছে। তারা যে কোনো ব্যাপারে সহজেই অস্থির হয়ে ওঠে সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। একসময়কার গুহাবাসী মানুষ বিদ্যুৎ চমকালে ভয় পেত, বজ্রপাতের নিনাদ শুনে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পালিয়ে বেড়াত। প্রথম শিল্পবিপ্লবের (১৭৬০-১৮৩০) অব্যবহিত পর থেকে সেই মানুষ যন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই শিল্পবিপ্লবের প্রথম দিকে মূল টার্গেট ছিল খনিজ লোহা থেকে ইস্পাত উৎপাদন। ইংল্যান্ডের আরনল্ড টয়েনবির প্রথম শিল্পবিপ্লবের ধারণা মানুষের প্রাচীন পেশা কৃষিকে বদলে দেয়। শুরু হয় শিল্প যুগের। সেই ১৮৬৩ সালে লন্ডনে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন দিয়ে এবং ১৮৯০ সালে বিদ্যুচ্চালিত ইঞ্জিন দিয়ে টিউব মেট্রোরেল চালু করে। এরপর হাঙ্গেরি ও স্কটল্যান্ড ১৮৯৬ সালে মেট্রোরেল চালু করে। আমেরিকার বোস্টনে ১৮৯৭ সালে এবং নিউ ইয়র্কে ১৯০৪ সালে মেট্রোরেল চালু করা হয়।
উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে দ্বতীয় শিল্পবিপ্লবের (১৮৭৫-১৯১৭) সময় লোহা দিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও রেলগাড়ি তৈরি করেছে। মোটর, রেডিও, টিভি, বিমান তৈরি করেছে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ১৯২৭ সালে এশিয়ায় প্রথম মেট্রো নেটওয়ার্ক চালু করে জাপান। জাপানের এদো রাজবংশের শাসনামলে ১৯৪১ সালে টোকিওতে আলাদা ৯টি মেট্রো লাইন চালু হয়ে যায়। মাটির ওপরে এবং মাটির বিভিন্ন স্তরে ৬০ ফুট নিচেও লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি ইত্যাদি বিভিন্ন রঙে ও নামে মিনিটে মিনিটে রেলগাড়ির চলাচল পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর টোকিওকে প্রাণ দিয়েছে। জনবহুল হয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের তালিকায় প্রথম স্থান অধিষ্ঠিত করে রাখাটা জাপানিজদের বড় সাফল্য। জাপানের চিকাতেত্সু বা সুড়ং রেলপথের স্টেশনের বাইরে হাজার হাজার কার পার্কিং, বাস স্টেশন, ট্যাক্সির সহজলভ্যতা সারা দেশকে একটি র্যাপিড গতিময়তা দান করেছে।
ঢাকা থেকে সরাসরি নারিতা বা হানেদা এয়ারপোর্টে নেমে আপনি ট্রেনে চড়েই যে কোনো বড় শহরের শিংকানসেন বা দ্রুতগামী বুলেট ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কয়েক ঘণ্টায় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দেশটির যে কোনো কর্নারে যেতে পারেন। শত শত মাইল দূরের গ্রামের বাড়িতে থেকে টোকিও বা ইয়োকোহামায় দৈনিক অফিস করতে পারেন। ওদের ট্রেনের সংখ্যা অনেক। ভ্রমণ খুব সস্তা ও নিরাপদ। এসব ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একাই নির্দ্বিধায় চলাচল করা যায়। বিদেশিরা ট্রেন চিনতে ভুল করলে রেলকর্মীরা হাসিমুখে খুব সহায়তা করে নির্দিষ্ট ট্রেনে তুলে দেন।
তাই তো পথে চলতে গিয়ে কোথাও তাদের সময়ের অপচয় হয় না। সেই জাপানিজরাই আমাদের মেট্রোরেলের নির্মাতা। কিন্তু তারা আমাদের অনিয়ম, আলসেমি ও অপরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুবই শঙ্কিত। কম্পিউটার আবিষ্কারের পর তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময়ে শিল্পযুগ থেকে তথ্যযুগে প্রবেশ করেছে। সেই ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্টভিত্তিক নেটওয়ার্ক ‘অরপানেট’-এর মাধ্যমে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে এক ধাপ এগিয়ে গেছে কৌতূহলী মানুষ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো স্মার্ট তথ্যপ্রবাহের যুগ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্যপ্রযুক্তির মেলা ‘সিবিট’-এ ২০১১ সালে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলা হয়। এটা নিয়ে পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচনা হয়। বলা হয়, শিল্পকারখানায় মানুষের পরিবর্তে ব্যাপক হারে রোবটের ব্যবহার সূচিত হয়েছে। এই যুগের বৈশিষ্ট্য হলো, রোবটের কাছে ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। রোবটকে যেখানে যে কাজে নিযুক্ত করা হবে, সে সেটাই করতে সচেষ্ট থাকবে। রোবটের ভেতরে মানবিকতা নেই। তার ভেতরের মাইক্রোচিপস বা তথ্যপ্রবাহ হাবে সংযোজিত হয়েছে, সেগুলোকে আদেশ করলে তার এক চুলও বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই সেই সব রোবটের। এতে সুবিধা হলো, তাদের দিনরাত একইভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে। রোবটের মধ্যে একঘেয়েমি বোধ না থাকায় এবং কোনো প্রতিবাদের ভাষা না থাকায় তারা মনিবের আদেশ পালনে সর্বদা উন্মুখ হয়ে শুধু কাজ করে চলেছে। এভাবে তারা কৃষি, শিল্পসহ ইত্যাদি উৎপাদন বাড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এই অতি যন্ত্রনির্ভরশীলতা বিপজ্জনক। উন্নত বিশ্বের মানুষ এখন পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের কথা বলছেন। পঞ্চম শিল্পবিপ্লব হলো একটি মানবিক ধারণা। ২০১৯ সালে জাপান ফেডারেশন অব বিজনেস সোসাইটি ৫.০ এটাকে সুপারস্মার্ট যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তরা বলেছে, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এতটাই যান্ত্রিক যে মানুষের জন্য সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা ডিজিটাল রুপান্তরের ভয়ংকর অংশটুকু ত্যাগ করতে চাই এবং ভালো অংশটুকু গ্রহণ করতে চাই।’ এই রূপান্তরকে সুপারস্মার্ট যুগও বলা হচ্ছে। কারণ, রোবট যন্ত্র যদি ক্রমাগতভাবে মানুষের সব কাজ দখল করে নেয়, তাহলে মানুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। চালকবিহীন গাড়ি নিজে নিজে চলে কোথায় যাবে? রেস্তোরাঁয় খাবারের প্লেট নিয়ে রোবট বয় কাকে আপ্যায়ন করাবে? পোশাক বানানো রোবটরা কার জন্য পোশাক বানাবে? রকেট, মহাকাশযান জ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ করে কাকে দেবে? বলা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে এখনো দিনে দিনে শিক্ষিত বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাবৎ উন্নতি হচ্ছে সম্পূর্ণ ধনীকেন্দ্রিক। মানুষে মানুষে ব্যাপক ফাঁরাক তৈরি হওয়ার জন্য দায়ি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রোবটাত্মা। এই রোবটাত্মার শুদ্ধি আনা যায়নি। এটা স্মার্ট যুগের বাস্তবতা। তাই রোবটের সঙ্গে মানুষের সাংঘর্ষিকতা এড়িয়ে চলার জন্য পঞ্চম শিল্পবিপ্লব অভিধায় একটি মানবিক শিল্পবিপ্লবের ধারণা বাস্তবায়ন শুরু করেছে উন্নত বিশ্ব।
এর মূল কথা হলো, মানুষকে কোনোভাবেই মাইনাস করা যাবে না। কোনো বাবা যদি তার সুপারস্মার্ট সুপারম্যান টাইপের সন্তানকে ঢাকায় বসে মনে করেন আমার ক্ষুধা লেগেছে, কিন্তু ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাবা, আমাকে এই মুহূর্তে আমেরিকার কেন্টাকি শহর থেকে চিকেন ফ্রাই এনে দাও। সে কি তাত্ক্ষণিকভাবে সেটা পালন করবে? এভাবে সব সুপারস্মার্ট সন্তানের বাবারা এ ধরনের সুপার বায়না ধরলে হঠাৎ তার অপ্রাপ্তি থেকে চারদিকে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এছাড়া জন্মহার, বয়স্ক মানুষের ক্রমাগত বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, গণদারিদ্র্য, মহামারি ইত্যাদির জন্য শুধু কিছু স্মার্ট যন্ত্রের ওপর আর নির্ভরশীল থাকা যায় না। এর জন্য দেশজ ধারণায় স্মার্ট প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও স্মার্ট মানুষের দক্ষতার সমন্বয়ে মিথষ্ক্রিয়া ঘটানো উচিত। এভাবে সুপারস্মার্ট সমাজ বা দেশের গোড়াপত্তন হতে পারে।
তাই একটি ম্যোরাল ক্লারিটির মাধ্যমে মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়ে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের দেওয়ালকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এর জন্য ইন্ডাস্ট্রি ৫ বা আইআর ৫ প্রযুক্তি, ক্লাউড কম্পিউটিং, সিমুলেশন, অগমেন্টেড রিয়েলিটি ইত্যাদিকে আরো বেশি মানবিক দৃষ্টিতে কাজে লাগানোর জন্য তত্পরতা চালাতে বলা হচ্ছে। ‘এখানে “আইওটি” বা ইন্টারনেট অব থিংকিংস ও কলাবোরেটিভ রোবট বা ‘কোবটের’ কথা বলা হচ্ছে। মানব ও মেশিন সহযোগিতার ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করবে, যা মানব উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’
উন্নত বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের কাজ শুরু করে দিয়েছে, তখন আমরা সবে চতুর্থ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। মানুষের অদক্ষতা, অনৈতিকতা ও চরম অবহেলার কারণে এসব কাজ শুরু করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। এটা আমাদের পশ্চাৎপদটা। সেসব কাজে সর্বসাধারণের সম্পৃক্ততা আনয়ন কঠিন ব্যাপার। যেখানে নেই সবার অংশগ্রহণের দক্ষতা এবং ফলাফল উপভোগ করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা। একটুতেই ধৈর্যহারা হয়ে মেট্রোরেল স্টেশনের কলাপসিবল টপকানো ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থার্টি ফার্স্ট নাইটে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আবাসিক এলাকার ছাদ থেকে আতশবাজি ফুটানো এবং হাজার হাজার বর্ণিল ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে বিপজ্জনক ঘটনা ঘটিয়ে নিজেকে স্মার্ট মনে করা শিক্ষিত মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি। এভাবে বেআইনি কাজ করে ইতিবাচক পরিবর্তন না চাওয়াটা স্মার্ট শহুরেদের একদিকে আনস্মার্ট, অন্যদিকে সুপারস্টার চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাদের সুপারস্টারগিরি দেখে সমাজের পিছিয়ে পড়া আনস্মার্ট মানুষ হঠাৎ সুপারস্টার সেজে আইন ভঙ্গে মেতে উঠলে সেটা সকলের জন্য সুখকর হবে কি?