দেশবাসীর স্বপ্নের সেতুতে চড়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। আজ বাদে কাল উদ্বোধন হচ্ছে দেশের ইতিহাসের অন্যতম মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের এ সেতুর উদ্বোধন করবেন, যার মধ্য দিয়ে লাঘব হবে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের আজন্ম কষ্ট। ঢাকার সঙ্গে পুরো দক্ষিণবঙ্গের সরাসরি এ যোগাযোগব্যবস্থা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিপ্লব সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। উদ্বোধন শেষে মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশ ও মাদারীপুর প্রান্তে জনসভায় যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন কেন্দ্র করে সারা দেশেই উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
উদ্বোধনের পরদিন ২৬ জুন ভোরে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বহুল প্রত্যাশিত এ সেতু। এতে ১৩ ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। তবে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না। এমনকি হেঁটেও মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুতে গাড়ি পারাপারে টোল নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। ঠিকাদার তাঁর কাজ শেষ করে সেতু বুঝিয়ে দিয়েছেন সরকারকে। তবে যে কোনো অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ছোটখাটো কাজ থাকবে। আগামী এক বছর ধরে তাঁরা সে কাজ ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ করবেন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ঘিরে দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের এ উৎসব কেন্দ্র করে যেন কেউ কোনো ধরনের নাশকতা চালাতে না পারে সেজন্য বাড়তি সতর্কাবস্থায় রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, বিচারপতি, বিশিষ্ট রাজনীতিক ছাড়াও বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। তাঁদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। কাল পদ্মার দুই পাড়েই র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ৫ হাজার সদস্য ইউনিফর্মে মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের গোয়েন্দা সদস্যরা সেতু ঘিরে দুই পাড়েই তৎপর রয়েছেন। সেতুর দুই প্রান্ত, সমাবেশস্থলসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড সুইপিং করবে। যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে র্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম। পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতিতে র্যাব এয়ার উইংয়ের হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে।
১১ পিলারে ১০ স্প্যান বসিয়ে তৈরি হচ্ছে জনসভার মঞ্চ : পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই সেতুর আদলেই তৈরি করা হচ্ছে মঞ্চ। ১১টি পিলারের ওপর ১০টি স্প্যান বসিয়ে ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থের বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের ঠিক সামনে পানিতে ভাসতে থাকবে বিশালাকৃতির একটি নৌকা। দেখে মনে হবে পদ্মা সেতুর পাশ দিয়ে বড় একটি নৌকা চলছে। আগামীকাল ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর ব্যতিক্রমী এ মঞ্চে উঠবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঐতিহাসিক রূপ দিতে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। সরেজমিন বাংলাবাজার ঘাটে মঞ্চ ও এর আশপাশ থেকে এমন তথ্যই জানা যায়। সভাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশাল এ আয়োজন ঘিরে পদ্মাপাড়ের মানুষের মধ্যে বইছে উৎসবের আমেজ। নিরাপত্তার জন্য মঞ্চের ভিতরে ও বাইরে বসানো হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। থাকবে দেড় শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা। র্যাব, পুলিশ, সেনাসদস্য, এসএসএফসহ নানা বাহিনীর তৎপরতায় এ অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে রূপ নেবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে। সভাস্থলে ৫০০ অস্থায়ী শৌচাগার, ভিআইপিদের জন্য আরও ২২টি শৌচাগার, সুপেয় পানির লাইন, তিনটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, নারীদের আলাদা বসার ব্যবস্থা, প্রায় ২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সভাস্থলে দূরের দর্শনার্থীদের জন্য ২৬টি এলইডি মনিটর ও ৫০০ মাইকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নদীপথে আসা মানুষের জন্য ২০টি পন্টুন তৈরি করা হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভ্রাম্যমাণ মোবাইল টাওয়ার নির্মাণ করছে। জনসভার মঞ্চ তৈরির কাজ করছে ক্যানভাস বাংলাদেশ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নকর্মী কবির হোসেন বলেন, ব্যতিক্রমী ওই মঞ্চ তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। কয়েক দিন ধরে তাঁরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকটা সেতুর আদলেই তৈরি করা হবে উদ্বোধনী মঞ্চ, যাতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। এ ছাড়া কয়েক স্তরের নিরাপত্তা শেড থাকবে। মঞ্চের সামনে পানি থাকবে। এর ওপর ছোট-বড় বেশ কয়েকটি নৌকা ভাসতে থাকবে। মঞ্চটি পুরো পদ্মা সেতুর আদলে তৈরি হয়েছে। এখন চলছে সাজসজ্জার কাজ। পুরো কাজের প্রায় ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে। শনিবারের আগেই কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
জনসভাস্থলের ২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেয়েছে পিয়ার সরদার অ্যান্ড সন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মোজ্জামেল হক বলেন, সভাস্থলে ওয়াচ টাওয়ার, এলইডি মনিটরসহ নিরাপত্তাবিষয়ক সব ধরনের কাজ তাঁরা শেষ করেছেন। স্মরণকালের সেরা আয়োজন হবে এখানে। জনসভায় আসা অতিথিদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সভাস্থলে নারীদের বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভিআইপি অতিথি, বিদেশি অতিথি ও কূটনীতিকদের জন্য আলাদা জোন করা হয়েছে। ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। বাকি ১০ ভাগ কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাবে।
ফায়ার সার্ভিসের ফরিদপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সভাস্থল ও নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ১০০ থেকে ১২০ জন ফায়ারম্যান কাজ করবেন। এ ছাড়া বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।’
ঘাট এলাকার বি এম হায়দার আলী বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণের সেতু। আমরা ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে; শুধু এ সেতুটির কারণে এত দিন অবহেলিত ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সেতুটি করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা এলাকাবাসী খুবই খুশি। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসবেন। সেতু উদ্বোধন করবেন, এটা আমাদের জন্য মহা আনন্দের। আমরা তাঁর অপেক্ষায় আছি।’
বাংলাবাজার ঘাটের শস্য বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গত বছর ঈদের সময় বাড়ি আসার পথে ফেরিতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করার কারণে পাঁচজন মরে গেছিল। এর আগে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জন লোক মরল। এ ছাড়া আগে-পরে আমার দেখা লঞ্চ ডোবাসহ ছয়-সাত শ লোক এ ঘাটে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা যান। অনেক কষ্টে ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষ। এখানে আর সেই কষ্ট থাকবে না। আমরা খুবই খুশি। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে সাময়িক সমস্যা হইব। তবে আমরা বাড়ির কাছে বাজারে দোকান ঠিক করছি। এ সমস্যা থাকবে না।’
মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নিরাপত্তা পরিকল্পনা গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এরই মধ্যে সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বাহিনী মাঠে কাজ করছে।’ মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাবুদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে অপেক্ষায় আছি।’