গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’—স্লোগানটি বিভিন্ন দেওয়াল, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বইয়ের কভার এবং যানবাহনের পেছনে প্রায় সময় দৃশ্যমান। কিন্তু, বাস্তবে এর প্রতিফলন কতটুকু পরিলক্ষিত হয়? স্ব স্ব স্থান থেকে কয়েক জন ব্যক্তি স্লোগানটি সামনে রেখে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন থেকে বিরত রয়েছে? কয়জন ব্যক্তি স্লোগানের আলোকে বৃক্ষরোপণ করে? প্রশ্ন করলে, কখনো ইতিবাচক উত্তর আসবে না। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে নীতিবাক্যগুলো সব সময়ই দেওয়াল, পাঠ্যপুস্তক এবং যানবাহনের পেছনে সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে তার প্রতিফলন দৃষ্টিগোচর হয় না।
সম্প্রতি, দেশের তাপমাত্রা জানান দিচ্ছে, আমাদের পরিবেশের কী ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছর থেকে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান বৃক্ষনিধন কার্যক্রম চলমান। প্রথমত, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, রাস্তাঘাট নির্মাণ, দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং বসতবাড়ি নির্মাণ, তৃতীয়ত, ফসলাদি জমি পাওয়ার জন্য। বর্তমান চাহিদার প্রেক্ষিতে উল্লিখিত বিষয়সমূহের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে; কিন্তু কেন আমরা নিধনের পর প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ করছি না? কেন আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না যে, একটি বড় বৃক্ষ কাটলে অন্তত ১০টি বৃক্ষরোপণ অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা, পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষের ভূমিকা সর্বাধিক। প্রয়োজনের তুলনায় বৃক্ষের সংখ্যা কম হলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বৃক্ষের অভাবে মাটি উর্বরতা হারায়। কেননা, মাটির উর্বরতা রক্ষায় বৃষ্টিপাত জরুরি। আর বৃষ্টিপাতের জন্য আবশ্যক বৃক্ষ। এছাড়াও, ভূমিক্ষয় রোধে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, মানুষের খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, গৃহনির্মাণসহ ইত্যাদি কাজে বৃক্ষ আবশ্যক।
উল্লেখ্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য। সেখানে, বাংলাদেশের বনভূমি রয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। সুতরাং, প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি রয়েছে শতকরা ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ঘাটতি রয়েছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের জলবায়ুর ওপর। যার দরুন প্রতি বছর আমরা ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্তত ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে, যার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। গত ৬০ বছরে ছোটবড় অন্তত ৩৩টি ঘূর্ণিঝড় দেশে আঘাত হেনেছে। শুধু শেষ ১৫ বছরে আঘাত হেনেছে অন্তত ৯টি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। পাশাপাশি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি তো রয়েছেই। ২০২২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, গত ৬ বছরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। জরিপের তথ্য মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষিখাতে ৫৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শস্যখাতে ২৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
মূলত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এখানে উন্নত দেশগুলোর দায়বদ্ধতা বেশি। প্রকৃত সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা বা সুযোগ না থাকলেও দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আরো অধিক বনভূমি বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ বন বিভাগের সূত্রে জানা গেছে, দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৬ শতাংশে উন্নতি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০৩০ সাল। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ করা এখন সময়ের দাবি। যাহোক, শুধু ‘বৃক্ষরোপণ দিবসে’ বৃক্ষরোপণ লোকদেখানো কাজ ব্যতীত পরিবেশ রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে না।