সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার উপকূলে প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এতে পর্যটনশিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এই ক্ষতি আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।
বাংলাদেশের অনুপম নিসর্গ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যটনশিল্প প্রসারের অনন্য উপাদান। এ অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগের জন্য বাংলাদেশে যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণপিপাসুদের। তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনার জের ধরেই গঠন করা হয়েছে টুরিস্ট পুলিশ। তারা এই খাতের নিরাপত্তায় দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটনশিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সমগ্র দেশে প্রায় ১ হাজার ৪০০টির অধিক পর্যটন আকর্ষণ চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনার চরে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রকল্প এবং ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির পরিকল্পনা বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে নতুন মাত্রা দেবে বলে মনে করা যায়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটক ও পর্যটন শিল্পের সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা হিসাবে ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিল্পের উন্নয়নে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশে ট্যুরিস্ট পুলিশ তার কার্যক্রম শুরু করে। নিঃসন্দেহে এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ পর্যটনস্থানগুলোতে ভ্রমণ করেন। এই খাতের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পর্যটকদের নিরাপদ আবাসন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভ্রমণ-অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা, পর্যটকদের আইনগত সহায়তা প্রদান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখা—এমন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেশ ও জাতির সেবায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ২০১৭ সালে মোবাইল অ্যাপ ‘হ্যালো ট্যুরিস্ট’ চালু করেছে যার মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটকদের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করা, কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া, কোনো পর্যটক অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে বা কোনো ধরনের সতর্কবার্তা থাকলে সেটি তাৎক্ষণিক পর্যটকদের অবহিত করা, অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাওয়া, দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে করে থাকেন। তারা সব সময় দর্শনার্থীদের খেয়াল রাখেন। কেউ কখনো অসুস্থ হলে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন। এছাড়া কোনো দর্শনার্থী যদি তার স্বজন হারিয়ে ফেলেন তাদের খোঁজার ক্ষেত্রেও পুলিশ সদস্যরা তৎপর। সব মিলিয়ে তাদের কার্যক্রমে পর্যটনশিল্প নতুন মাত্রা পেয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভয় ও শিহরন সুন্দরবন। কিংবা স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ষাটগম্বুজ মসজিদ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই স্পটগুলোতে প্রতি বছর ভ্রমণ করেন হাজার হাজার পর্যটক। ট্যুরিস্ট পুলিশ তথ্য অনুযায়ী, এসব জোন অফিসের পর্যটন স্পটগুলোতে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫২৩ জন দেশি পর্যটক, ৫৩৪ জন বিদেশি পর্যটক ও ১ হাজার ২২ জন ভিআইপি/গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভ্রমণ করেছেন, যাদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করেছেন বাহিনীর সদস্যরা। সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন করমজলে। এখানে প্রায় সব সময় ট্যুরিস্ট পুলিশ অবস্থান করেন। অনেক সময়ে পর্যটক ও তাদের বহনকারী ট্রলার মালিকরা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। এসব তারা মীমাংসা করে দেন। ভ্রমণের সময়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কেড়ে নিতে পারে সব আনন্দ। সেজন্য বনের ভেতরে সব পর্যটনকেন্দ্রে তারা নিয়মিত টহল দেন। পর্যটকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের চলাচলে দিকনির্দেশনা দেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অনেক কমানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া তারা পর্যটকদের ট্যুরিস্ট পুলিশের মোবাইল ফোন নম্বর সেভ করে রাখতে উৎসাহিত করেন। ফলে পর্যটক কোনো বিপদে পড়লে তারা তাৎক্ষণিক উদ্ধার করতে পারেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশ শুধু পর্যটকদের যে কোনো সমস্যা সমাধান, হয়রানি রোধ, বখাটে ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রতিহত করেন না বরং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রত্নসম্পদ চুরি ঠেকানো এবং পর্যটন সম্পদ ধ্বংস প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বা আরো উন্নয়নমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য উপযুক্ত সমাজনীতি (সোশ্যাল পলিসি) নির্ধারণ, উপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি। এজন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের সংখ্যা ও তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গ্রেফতারসহ নানা ক্ষেত্রে তাদের তাৎক্ষণিক ক্ষমতা প্রদান, থাইল্যান্ডের মতো তাদের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক পর্যটন কার্যক্রম পরিচালনা, দেশে-বিদেশে তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, পর্যটন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অধিকতর গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, টুরিস্ট পুলিশের আন্তরিকতায় পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ভালো ব্যবসা করতে পারছেন। ফলে যেমন দর্শনার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়তি রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। তাই ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি।