পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ‘ক্ষমতার গদি থেকে কারাগার’ নামক প্রহসনের আরো একটি পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। এক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটটি সহজেই অনুমেয়। আরো এক জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক জীবন গভীর খাদে পড়ল। ইমরান খানের সাজা ও অযোগ্যতা ঘোষণার পূর্বাভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল, যেমনটি এ দেশের অন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও হয়েছিল। ইমরানের বিরুদ্ধেও তার পূর্বসূরিদের মতো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
ব্যক্তি দোষী কি না, তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক; ‘প্রতাপশালী প্রতিপক্ষ’কে বশীভূত করাটাই মুখ্য। এক্ষেত্রে সবকিছু যেন স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চলছে বলেই মনে হচ্ছে। ইমরান খানকে নির্বাচনি দৌড় থেকে দূরে রাখাটাই মূল অভিসন্ধি। সাম্প্রতিক আদালতের রায় হয়তো আপাতত উদ্দেশ্য পূরণ করেছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) ভেঙে দেওয়ার প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। খানের কারাবাস তার জনপ্রিয় সমর্থনভিত্তিকে প্রভাবিত করেছে বলেও মনে হয় না। এই খেলার কেবল শুরু, যা কিনা এখন দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ও আইনি লড়াইয়ে রূপ নিতে যাচ্ছে।
জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাকিস্তানে নির্বাচন হবে কি না, তা ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। শেষ মুহূর্তে এসে সর্বশেষ আদমশুমারির ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সংবিধানের ৯০ দিনের মধ্যে ভোটগ্রহণের নিয়ম পালনে বিলম্ব হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই বিলম্ব নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনি আসনের সীমানা চিহ্নিতকরণ কার্যক্রম শেষ করতে প্রয়োজনীয় কয়েক মাস সময়কে অতিক্রম করতে পারে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানে নিরাপত্তা সংস্থার দ্বারা সমর্থিত, একটি দীর্ঘায়িত এবং ক্ষমতাশালী তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের আগমনের সম্ভাবনা প্রকট। ফলে স্তিমিত হবে দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রত্যাশা। জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে যেই নজিরবিহীনতার সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে সংসদের মাধ্যমে একাধিক আইন প্রণয়ন করা হলো, তা নানা সন্দেহকে আরো জোরদার করেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বিলের সংশোধনী পাশ করা দেশটির নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছে, যা নাগরিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। যদিও সিনেটে প্রবল প্রতিবাদের পর কিছু বিধান শিথিল করা হয়েছিল, তবে এর সামগ্রিক প্রভাব কোনোভাবেই ভোঁতা হয়নি।
নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর এহেন লাগামহীন ক্ষমতা গণতন্ত্রবহির্ভূত শক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করবে। এটা বিরোধী পক্ষকে চুপ করানোর পরিকল্পনার অংশ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন জোট যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে তা হলো, এই সব নীতি তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলগুলোকে তাড়া করতে এই শক্তিগুলোই যে ফিরে আসবে, তা নিশ্চিত। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কালো ছায়া ইতিমধ্যে দীর্ঘ হয়ে গেছে। ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত্ নিয়ে। আমরা হয়তো স্থায়ীভাবে একটা মিশ্র শাসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে বেসামরিক জনসাধারণের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ছে। অর্থনীতি পরিচালনাসহ বেশ কয়েকটি বেসামরিক ক্ষেত্রে সামরিক নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার সঙ্গে ইতিমধ্যে নিরাপত্তা সংস্থার ক্রমাগত আধিপত্যের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন জোট কার্যত বেসামরিক কর্তৃত্ব বিসর্জন দিয়েছে।
প্রাথমিকভাবে মন্থর হয়ে থাকলেও বর্তমানে যা ঘটছে তা দেশটির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি দুঃখজনক পশ্চাত্পদ অধ্যায়। গত ১৬ মাস এই পশ্চাত্পদ যাত্রারা সাক্ষী। এই ঝড়ের কেন্দ্রে থাকা পিটিআই তাদের ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক ভাষ্য দিয়ে দিয়ে সিস্টেমকে দুর্বল করার জন্য সমানভাবে দায়ী।
সংসদীয় নিয়মকানুনের পথে না গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুরো ব্যবস্থাপনাকেই ধ্বংসের উদ্দেশে একটি সংঘাতমূলক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। তার পপুলিস্ট বক্তৃতা এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ তার জন্য জনসমর্থন বয়ে আনলেও তার বেপরোয়া আচরণ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তিনি একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও নিরাপত্তা সংস্থায় পূর্ববর্তী পৃষ্ঠপোষকদের বিপক্ষে গেছেন। ফলে এখন তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার মূল্য দিতে হচ্ছে। তার জনপ্রিয়তার ভিত অক্ষুণ্ন থাকলেও বেশ কয়েক জন নেতার পদত্যাগের চাপে দলটিতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
এত কিছুর পরেও খানের বিবৃতি ছাপানো বা সম্প্রচারে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও তার সমর্থন হারানোর কোনো লক্ষণ নেই। বরং, গ্রেফতারের পর তার জনপ্রিয়তার গ্রাফ যেন আরো বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং পিটিআই ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দলটি এখনো বেশ শক্তিশালী। তুলনামূলকভাবে বাধাহীন ভোটের মধ্যেও দলটি পাঞ্জাবের নির্বাচনি রণাঙ্গনে নওয়াজ শরীফের মুসলিম লিগের সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে সক্ষম। সম্ভবত অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার ভয়ে পিডিএমকে নিরাপত্তা সংস্থার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং এটি অন্য বেসামরিক অংশীদারের সঙ্গে মিলে একটি নতুন হাইব্রিড ব্যবস্থার উত্থানের পথে হাঁটছে। পিটিআই চ্যালেঞ্জ দূর করার বিষয়ে উভয়ের মধ্যে সম্পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে।
পিডিএম সরকারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সবার দৃষ্টি এখন গঠিত তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের দিকে। প্রধান বিরোধী দল পিটিআই পরামর্শ প্রক্রিয়ার বাইরে থাকায় অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করার দায় জোটের অংশীদারদের ও বিরোধী দলের একজন নামমাত্র নেতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং অবশ্যই এই মনোনয়নে নিরাপত্তা সংস্থারও স্বার্থ নিহিত, যা একটি নির্দলীয় সংস্থা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।
দীর্ঘস্থায়ী অন্তর্বর্তী শাসনের সম্ভাবনার সঙ্গে আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে প্রশাসন পরিচালনার জন্য একটি ক্ষমতাপ্রাপ্ত টেকনোক্র্যা সিস্টেম স্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থার মানে হবে কার্যত সামরিক শাসন। এ ধরনের প্রতিনিধিত্বহীন, টেকনোক্র্যাট-সামরিক শাসন কি রাজনৈতিকভাবে অস্থির পরিস্থিতিকে কোনোভাবে স্থিতিশীল করতে পারবে? অবশ্যই না। বিরোধী দলকে দমন করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নির্মম ব্যবহার পরিস্থিতি আরো খারাপ করবে, যার হাল নিয়ন্ত্রণ করা যে কারো পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট এবং ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদের মধ্যে থাকা একটি দেশের জন্য এটি প্রচণ্ড বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতি তৈরি করছে। একজন জনপ্রিয় নেতাকে একঘরে করে ফেলা এবং রাজনৈতিক দল ভাঙা-গড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করলে অস্থিরতা দূর হবে না। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের ইতিহাস থেকেও কখনোই শিক্ষা নেয়নি। সংঘাত ও প্রতিহিংসার রাজনীতি ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত করেছে। নির্বাচন বিলম্বিত করা কোনো সমাধান নয়, বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরা সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই দায়িত্ব। দুঃখজনকভাবে, তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। রাজনৈতিক সমঝোতার সময় শেষ বলেই মনে হচ্ছে। দেশে সুবিবেচনা বিদ্যমান থাকবে, এটা কেবলই আশা করা যায়।