পাকিস্তানের আজকের পরিণতির জন্য দায়ী কে? দেশটির এই ‘হাল’ হলো কী করে? এর উত্তরে যদি বলা হয় এর দায় সেনাবাহিনীর, তবে কি ভুল বলা হবে? এই দাবির পক্ষে যুক্তি হলো, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তা থেকে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র ও টালবাহানার কারণেই পাকিস্তান আজকের অচলাবস্থায় ভুগছে।
চলতি বছরের শেষের দিকে নভেম্বর নাগাদ পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)-এর মতো দল কিংবা কয়েকটি দলের জোটবদ্ধ বিজয়ে কি পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে, নাকি চলমান বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে সামনের দিনগুলোতে?
এ কথা বলার কারণ, বর্তমানে পাকিস্তান এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ করা ক্রমশ কঠিনতর হয়ে পড়ছে। দেশটির রাজনীতিবিদেরা কেবল আহাম্মকই নন, তারা শান্তিবিরোধীও! জাতীয় স্বার্থ সব সময়ই উপেক্ষিত হতে দেখা যায় এ দেশে—এ নিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীরও কোনো মাথাব্যথা নেই! অর্থাৎ, সেনাবাহিনী বা রাজনীতিবিদ—উভয় গোষ্ঠীর হাত ধরে দেশটির উৎপাদন কেবল নিচের দিকে নামছে ক্রমাগত। আজকের পাকিস্তানের অবস্থা যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কাহিল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে না পারলে অবস্থা আরও সঙ্গিন হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। ৩৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি উত্তপ্ত করে তুলেছে দেশটির অর্থনৈতিক অঙ্গনকে। এর ফলে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক দিন যাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে স্বভাবতই। ঘটনা আছে আরো—৫৮ ট্রিলিয়ন রুপি বিদেশি ঋণের বোঝার ভারে নুয়ে পড়েছে দেশটি। সব মিলিয়ে ভেতরে-বাইরে তীব্র অস্থিরতায় নিপতিত আজকের পাকিস্তান। পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক খবর হলো, এত কিছুর পরও বেসামরিক সামরিক নেতৃত্বকে (সিভিল মিলিটারি লিডারশিপ) প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী দেখা যায় না।
এমনকি উপরোল্লিখিত নেতিবাচক সংবাদগুলোর পাশাপাশি দেশটির জন্য নতুন উদ্বেগজনক খবর হলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি দেশটির জনগণের ‘বিশ্বাস’ উঠে গেছে ব্যাপকভাবে। অথচ এই সেনাবাহিনীর প্রতিই পাকিস্তানের জনগণ ‘অন্ধ বিশ্বাস’ করে এসেছে! সেনাবাহিনীকে দেশের আদর্শিক ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার রক্ষাকবচ বলে মনে করে জনগণ। সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা এতটাই অটুট যে, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সেনাবাহিনীর করুণ পরাজয়ও এই বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারেনি!
প্রশ্ন উঠতে পারে, পাকিস্তানের আজকের পরিণতির জন্য দায়ী কে? দেশটির এই ‘হাল’ হলো কী করে? এর উত্তরে যদি বলা হয় এর দায় সেনাবাহিনীর, তবে কি ভুল বলা হবে? এই দাবির পক্ষে যুক্তি হলো, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজজীবনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চিন্তা থেকে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র ও টালবাহানার কারণেই পাকিস্তান আজকের অচলাবস্থায় ভুগছে। এ কথা বলে রাখা জরুরি যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মই যেন অদ্ভুত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে! এটা এমন এক দেশ, যা না ইসলামি রাষ্ট্র, না গণতান্ত্রিক। সহজ করে বললে, পাকিস্তানের ব্যবস্থাকে যেন কোনো ব্যবস্থার আলোকেই সজ্ঞায়িত করার উপায় নেই! পাকিস্তানের সিস্টেমটাই অনেকটা এরকম যে, দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে পারে কেবল সেনাবাহিনীই! এই ব্যবস্থার মুখে ছাই দিতে কখনো কখনো কেউ কেউ এগিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু সেনাবাহিনীর এই ধরাবাধা বৃত্ত থেকে বের করা যায়নি সিস্টেমকে। একটি গল্প আছে, কোনো এক লোক একটি ডালের ওপর বসে সেই ডালটিই কেটে ফেলতে চেষ্টা করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও সেই কাজটিই করেছে ২০১৭ সালে।
দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর পক্ষে পরিচালনা করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে বোকামি করে বসে সেনাবাহিনীও। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর মতাদর্শ ছড়িয়ে ক্ষমতায় বসে। যদিও সংসদে দলটির কর্তৃত্ব ছিল ‘নামমাত্র’। তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, যার হাতে কিনা শক্তিশালী অল পাকিস্তান পলিটিক্যাল পার্টির নেতৃত্ব ছিল, সংসদ সদস্য ও তার নিজ দলের নেতৃত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেয়।
এভাবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলকে বিশৃঙ্খলায় ছুড়ে ফেলা হয়। দ্বিতীয় শীর্ষ দল পিপলস পার্টি অব পাকিস্তানকে (পিপিপি) ফেলে দেওয়া হয় নেতৃত্বের সংকটের মধ্যে। নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবারের সদস্যদের পাঠানো হয় কারাগারে। নওয়াজের দল মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বেশ দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এই দলের নেতাকর্মীদের পিটিআইতে যোগ দিতে উৎসাহিত করা হয়। সে সময় যারা পিটিআইতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা জানতেন এর পেছনে সেনাবাহিনী আছে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনেও প্রমাণিত হয়েছে যে, সেনাবাহিনী ইমরান খানের পক্ষে নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে—ভোটাররা এবং মিডিয়া যেভাবেই দেখুক না কেন। সেনাবাহিনী অযোগ্য কিন্তু দাম্ভিক ইমরান খানকে চার বছর জোরপূর্বক ক্ষমতায় রেখেছে। যে সেনাবাহিনী প্রায় ৪৪ বছর ধরে পাকিস্তান শাসন করেছে, তারা অযোগ্য ইমরানের সঙ্গে সর্ববিষয়ে জড়িয়ে থেকে নিজেদের চেহারা উন্মোচন করেছে।
জেনারেল জাভেদ বাজওয়া সেনাপ্রধান হিসেবে তৃতীয় মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান চেয়েছেন সর্বাগ্রে পিডিএমের অনাস্থাটি তার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলতে। অনাস্থা প্রস্তাব সফল হয়েছিল এবং সেনাবাহিনী আরেক নির্বোধ শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে, যিনি দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সবকিছু ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হননি, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কুখ্যাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শাহবাজ যা-ই করুন না কেন, তার বদনাম গিয়েছে সেনাবাহিনী ঘাড়ে। এর মধ্যেই গুঞ্জন উঠেছে, সেনাবাহিনী এখন বিলাওয়াল ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী করতে চায়। এই গুজব সঠিক প্রমাণিত হলে পিডিএম ভেঙে যাবে, পিটিআইকে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে না। কিন্তু পিডিএম ভেঙে গেলে সেনাবাহিনীর কী হবে? পিপিপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে আগামী নির্বাচনে কারচুপি করতে হবে, যে পিটিআইয়ের সঙ্গে সেনাবাহিনীর শত্রুতা সর্বজনবিদিত। পিডিএম খণ্ড হয়ে গেলে এবং ভেঙে পড়লে দিশেহারা পিটিআই, যার অনেক হেভিওয়েট সদস্য এখন দলে নেই, পরবর্তী নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ক্রীড়নকে পরিণত হবে। যদি বিলাওয়াল পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে দলত্যাগীদের দলে ফিরিয়ে আনতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু একটা দেশে এটা কি সেনাবাহিনীর কাজ হতে পারে? সেনাবাহিনী যত খুশি রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাগ করতে পারে। কিন্তু তা কি দেশের জন্য কোনো ভালো কিছু আনতে পারে?
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায়, পাঞ্জাবের প্রভাবশালী সুগার মাফিয়াপ্রধান জাহাঙ্গীর তারিনকে ঘিরে সেনাবাহিনী আরও একটি খেলা খেলতে পারে। সত্য হলে আসন্ন নির্বাচন এমন ফলাফল দেবে, যা একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনকে অসম্ভব করে তুলবে। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বন্ধুরা এবং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পঞ্চম সামরিক শাসন বেছে নিতে পারে, যা মন্দের মধ্যে কম মন্দ। ৯ মে সামরিক স্থাপনায় জনতার আক্রমণ একটি বার্তা দিয়েছে যে কমন কাউকে সেনাবাহিনী আর নিশ্চিত নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।