সোনালি আঁশখ্যাত পাটের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। পাটখাত দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী অন্যতম ক্ষেত্র। দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে মানানসই পাট ও পাটজাত পণ্য দেশে-বিদেশে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে সমাদৃত। আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৩ শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা ৩ ভাগ। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে পাট খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশের ওপর প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে বিকল্প প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের।
আধুনিকায়ন ও বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পাটের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী সোনালি আঁশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরার লক্ষ্যে পাটপণ্যকে ‘বর্ষপণ্য ২০২৩’ এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রিসভা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সোনালি আঁশ পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং গত ১ মার্চ ২০২৩ প্রজ্ঞাপনের গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। পাট কৃষিজাত পণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখন থেকে কৃষিঋণের মধ্যে পাটও যুক্ত হবে এবং পণ্য রপ্তানিতে পাবেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। কৃষি বিপণন আইন অনুসারে কৃষিপণ্য হিসেবে এখন থেকে পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
দেশের অভ্যন্তরে পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি পাট চাষসহ পাট খাতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’, ‘পাট আইন, ২০১৭’, জাতীয় পাটনীতি, ২০১৮’ এবং ‘চারকোল নীতিমালা, ২০২২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন, পাটচাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও উদ্ধুদ্ধকরণ এবং উন্নতমানের পাটবীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)-এর নিবন্ধিত উদ্যোক্তাগণ বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক গুণসম্পন্ন নতুন নতুন ডিজাইনের বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন এবং বিশ্ববাজারে বহুমুখী পাটজাতপণ্যকে জনপ্রিয় করতে প্রচার-প্রচারণাসহ বিদেশে বিভিন্ন মেলার আয়োজন করার কাজ চলমান রয়েছে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা প্রদান করছে সরকার। এছাড়া পাটবীজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি রোডম্যাপও তৈরি করা হয়েছে।
কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ববাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে। হাতে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য ও কার্পেট মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদীভাঙন রোধে পাটের বস্তা ব্যবহার বাড়ছে। পাট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে কয়েক গুণ। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪টি দেশে। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে প্যাকিং সরঞ্জাম, স্মার্ট পাটের ব্যাগ, পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, জুতা, স্যান্ডেল ও বাস্কেটের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ ছাড়াও যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে দাতা সংস্থার ত্রাণসামগ্রী উড়োজাহাজ থেকে নিচে ফেলতে পাটের দড়ি ও বস্তার চাহিদা বেড়েছে। পাট পাতার সুপ ও পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়া থাইল্যান্ড, চীন ও জাপানে এ সুপের বেশ কদর রয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাটপাতা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
পাটের আঁশের পাশাপাশি সম্ভাবনার নতুন খাত হিসেবে আবির্ভূত পাটখড়ি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল। এই চারকোল থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। কার্বন ফ্যাক্টরি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন চারকোল রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার বা প্রায় ২৫ কোটি টাকা। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল গাড়ি ও উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়রও তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। জাপানের টয়োটা কোম্পানির গাড়ির বডিতে পরিবেশবান্ধব পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আমেরিকার শীর্ষ গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জিএম মোটরস এবং জাপানের মিতশুবিশি কোম্পানিও তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পাট ব্যবহার করছে। টয়োটা গাড়ির বডির ৩৭ শতাংশে পাট ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরির চিন্তাভাবনা চলছে। এজন্য বিশ্ববিখ্যাত কানাডিয়ান ফেল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কান্ট্রি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে। প্লাস্টিকের সঙ্গে ৩০ ভাগ পাট মিশিয়ে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি করা হবে, যা পরিবেশবান্ধব হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) গাড়ির বডিতে ব্যবহারকৃত কাচ, অ্যাজবেসটস ও প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব পাট ব্যবহারের জন্য গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পাটবস্ত্রের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে। মধ্যযুগে মহর আলীর পাটের শাড়ি, হাজার বুটিক পাটের শাড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের নুরলদীনের সারাজীবনে আগুন পাটের শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। পাটখড়ি থেকে বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা পারটেক্স আবিষ্কার করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই।
কালের পরিক্রমায় কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যুগে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটপণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও মাটি পাট উত্পাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদা মেটাতে, পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আমাদের কাজ করতে হবে। পাটের সোনালি অতীত ফিরে আসার ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।