- বানভাসিদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ
- বিদ্যুতবিহীন দুই জেলা
- যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
- ভেঙ্গে পড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক
- ২২ জুন পর্যন্ত লন্ডন ফ্লাইট বাতিল
সালাম মশরুর, সিলেট অফিস ॥ সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিতে নদ-নদী ও হাওড়ের পানিবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। শনিবার পর্যন্ত পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন উভয় জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। শনিবার সকাল ৯টা থেকে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি প্রবেশ করায় জেলার কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে ন্যাশনাল গ্রিড থেকে সিলেটে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। শনিবার দুপুর সোয়া ১২টা থেকে পুরো সিলেট জেলা বিদ্যুতবিহীন। পানিবন্দী মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙ্গে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছে শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনো ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্গতরা।সিলেটের সবক’টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ও সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক। দুই জেলায় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সুনামগঞ্জে গত দুদিন ধরে বিদ্যুত না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সিলেটের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার রাতে সিলেটে বৃষ্টি কিছুটা কম ছিল। এতে পানি এক-দুই ইঞ্চি কমেছিল। তবে, শনিবার সকাল থেকে সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় জেলার নতুন নতুন উঁচু এলাকা প্লাবিত হয়। পানির নিচে তলিয়ে যায় সবগুলো রাস্তাঘাট। সিলেটে আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দী লোকজনকে উদ্ধারে সেনা ও নৌবাহিনী তৎপর রয়েছে। শুক্রবার বিকেল থেকে সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন, ছয়টি মেডিক্যাল টিম এবং শনিবার সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে। সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ মজিবর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। উদ্ধারকাজে নৌবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। ৬০ জনের আরেকটি দল উদ্ধারকাজে যুক্ত হবে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতে সিলেট এসে পৌঁছায়। শনিবার সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের একটি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেছে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে একটি টিম সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। আরেকটি টিম কোম্পানিগঞ্জে কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, শনিবার বিকেলে নৌবাহিনীর আরও ৬০ সদস্যের একটি দল সিলেট এসে পৌঁছায়। আরও দুটি ক্রুজ উদ্ধারকাজে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে একটি সিলেটে ও অন্যটি সুনামগঞ্জে উদ্ধারকাজে যুক্ত হবে। সিলেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ শাখা জানিয়েছে, ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৭ হাজার ৯০০ বস্তা শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও ৮ হাজার প্যাকেট খাবার ও ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব এলাকায় আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এর পর বেশিরভাগ বন্যা মূলত হাওড় ও নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই-তিনদিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়েছিল। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় সব অংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওড় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুইদিন ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা বলেছে, সোমবার বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত তিনদিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই। বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশিরভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে।
একদিকে বন্যার পানি, অন্যদিকে আটকেপড়া মানুষের আহাজারি- এমন বিপর্যয় আর দেখেনি সিলেটবাসী। বিভীষিকাময় অবস্থায় রয়েছেন বানবাসীরা। নারী-পুরুষ, শিশুরা ছুটছেন আশ্রয়ের খোঁজে। দুদিন আগেও কেউ স্বপ্নে ভাবেনি এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। বিদ্যুত, পানি, খাদ্য, যোগাযোগ সবদিকে সঙ্কট। নগরীতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন কেনাকাটা করতে। এই সুযোগে পণ্যমূল্য কয়েকগুণ বেড়েছে। সঙ্কট দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেল ও মোমবাতির। বন্ধ রয়েছে বিমানবন্দর, বাস, ট্রেন। হাসপাতালে নিহতদের লাশ গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ ॥ শুক্রবার সকাল থেকে কুমারগাঁও বিদ্যুতকেন্দ্রে পানি ঢোকা শুরু হয়। খবর পেয়ে ওই দিন সকালে ছুটে যান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে বিদ্যুতকেন্দ্রের চারদিকে বাঁধ দিয়ে সেচ দিয়ে পানি কমানোর উদ্যোগ নেন। এর পর এই কাজে যুক্ত হন সেনা সদস্যরা। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেনা সদস্যরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে বালু, মাটি ও পাথরের বস্তা ফেলে বিদ্যুতকেন্দ্রের চারদিকে বাঁধ দেন। কিন্তু শুক্রবার মধ্যরাত থেকে টানা ভারি বর্ষণের কারণে শনিবার সকাল থেকে পানি হু হু করে বাড়তে থাকে। বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে কুমারগাঁও বিদ্যুতকেন্দ্রে। ফলে বাধ্য হয়ে কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র থেকে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। বিউবো সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদির জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত কমলে সেচ দিয়ে পানি কমানো গেলে আবারও বিদ্যুতকেন্দ্রটি চালু করার চেষ্টা করা হবে।
অপরিসীম দুর্ভোগ ॥ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আবদুল কাদির বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। ২৯ বছরেও এমন দেখিনি। কখনোই কুমারগাঁও গ্রিড লাইনে পানি ওঠেনি। এবারের পানি ভয়ঙ্কর। একই কথা সকলের মুখে ‘এইভাবে পানি আর কখনও হয়নি। জেলা তলিয়ে গেছে, কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নৌকার অভাবে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।’ বিদ্যুতের অভাবে খাওয়ার পানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে নগরীর বহু এলাকায়। নগরীর তালতলা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত মাসের বন্যায় সাতদিন পানি ছিল না। গোসল করতে পারিনি। এবারও একই সমস্যায় পড়েছি। ক্যাম্পাসে পানি উঠে যাওয়ায় আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার সিন্ডিকেটের জরুরী সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ছুটি বাতিল ॥ বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল। জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সিলেটের সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে রাখা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় অফিসকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এর পর থেকে বন্যায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম আরও জোরদার হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বলেন, সিলেটের বন্যায় মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের নেতৃত্বে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও।
২২ জুন পর্যন্ত লন্ডনের ফ্লাইট বাতিল ॥ সিলেট থেকে লন্ডনগামী সব ফ্লাইট বাতিল করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানবন্দরের রানওয়েতে বন্যার পানি প্রবেশ করায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্লাইট বন্ধ থাকবে বুধবার পর্যন্ত। শনিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ জানান, ফ্লাইটটি শনিবার সকাল ৮টায় ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। সেটি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে আবার রবিবার ও বুধবার বিমানের ঢাকা-সিলেট-লন্ডন ফ্লাইট রয়েছে। সেগুলোও বাতিল হয়েছে। বেবিচক জানায়, বাতিল করা ফ্লাইটের তারিখ পরবর্তীতে জানিয়ে দেয়া হবে।
সিলেট নগরীর কিছু এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ চালু ॥ সিলেট নগরীতে ধীরে ধীরে বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হচ্ছে। শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে নগরীর কয়েকটি এলাকায় আংশিকভাবে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। তবে আপাতত নগরীর উঁচু এলাকাগুলোতে বিদ্যুত সরবরাহ করা হবে বলে জানা গেছে। শুক্রবার সকাল থেকে কুমারগাঁও বিদ্যুত কেন্দ্রে পানি ঢুকতে শুরু করলে ছুটে যান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে বিদ্যুত কেন্দ্রের চারদিকে বাঁধ দিয়ে সেচের মাধ্যমে পানি কমানোর উদ্যোগ নেন। এরপর এই কাজে যুক্ত হন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। প্রাণান্তকর চেষ্টার পরও সচল রাখা যায়নি সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্র। ভারিবর্ষণের ফলে পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ করে দিতে হয় বিদ্যুত উপকেন্দ্রটি। ফলে ন্যাশনাল গ্রিড লাইন থেকে সিলেটে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ে। শনিবার দুপুর সোয়া ১২টা থেকে পুরো সিলেট জেলা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে নগরীর কয়েকটি এলাকায় আংশিকভাবে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়।