পানি ও স্যানিটেশনের সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আগামী ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হচ্ছে। জল ও স্যানিটেশনের সংকট সমাধানে বিশ্বকে একত্রিত করার লক্ষ্যেই দিবসটি গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এসডিজি-৬ অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশন প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যমতে, এসডিজি-৬ অর্জনে সরকারগুলোকে গড়ে চার গুণ দ্রুত কাজ করতে হবে।
পানির অপর নাম জীবন। সেই পানি নিরাপদ না হলে ধ্বংস বয়ে আনে। পানি যখন সুপেয় না হয়, তখন তা হয়ে ওঠে নানা অসুখ, নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যাসহ মরণেরও কারণ। পানির সংকট বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সংকট। ক্রমান্বয়ে এই সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এই সংকট। বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী পানিসংকটের মধ্যে রয়েছে। পৃথিবীতে যত মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে। পানিবাহিত রোগের প্রভাবে মৃত্যুর পরিমাণ এখনো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। ডায়রিয়া, কলেরাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করে হাজারো মানুষ। এদের অধিকাংশই আবার শিশু। সুপেয় পানিপ্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পানি অধিকারকে জাতিসংঘ মানবাধিকার হিসেবেও ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিশ্বের ৭৬ কোটিরও বেশি মানুষ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই সুপেয় পানির অধিকার রক্ষা না হলে সংকটাপন্ন এলাকাগুলো আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
এশিয়া ও আফ্রিকার এই সংকট আরো ভয়াবহ। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। অথচ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতি আছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা প্রলয়ের পর এই সংকট আরো তীব্র হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এখনো পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে কমে গেছে পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় গড় বৃষ্টিপাত। একদিকে অস্বাভাবিক জোয়ারে বাঁধের নাজুক পরিস্থিতি, অন্যদিকে পানযোগ্য পানির অভাবে চিন্তা বাড়িয়েছে উপকূলীয় মানুষগুলোর। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, পানির দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র পানিসম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে বাধ্য হয়ে পানযোগ্য একটু পানির খোঁজে উপকূলীয় মানুষ কলসি, বোতল, ড্রাম নিয়ে নৌকা বা ভ্যানযোগে দূরদূরান্তে ছোটে।
নিত্যব্যবহার্য কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি। পেটের পীড়া, অ্যালার্জিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নারী, শিশু থেকে বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষ। লবণাক্ত পানিতে নানা চর্মরোগসহ দূর থেকে পানি আনায় শারীরিক বিভিন্ন ঝুঁকিও আছে, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চরক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীর গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শুধু লবণাক্ততাই নয়, বিশ্ব জুড়ে পানির নতুন বিপদ হিসেবে অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সমস্যাকে সামনে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকের কারণে পানিদূষণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, এসব সমস্যা বিশ্বের সুপেয় পানির উত্সগুলোকে বিষিয়ে তুলছে।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশের জলাভূমি কমেছে ৭০ ভাগ। অনেক নদ-নদীও শুকিয়ে গেছে। সারা দেশে কমপক্ষে ৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বন্ধে পাকিস্তান আমল থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বেড়িবাঁধ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সিডর ও আইলার পর অনেক স্থানেই সেই বাঁধ ভেঙে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে মূলত দুটি প্রাকৃতিক কারণকে দায়ী করা হয়। এক. জোয়ারের সময় লবণযুক্ত পানি জমিতে প্লাবিত হয়ে; দুই. ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি কৈশিক রন্ধ্র দিয়ে মাটির ওপরে চলে আসে। শুকনো মৌসুমে লবণাক্ত পানি জোয়ারে এসে বহু জমি তলিয়ে দেয়। এই পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি আরো লবণাক্ত হয়। অন্যদিকে বর্ষা শেষ হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মাটি শুকাতে শুরু করে। এর ফলে মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি হয়। যখন মাটির ওপরে রোদ পড়ে, তখন মাটির উপরিস্তর থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায় এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি ঐ ফাটল দিয়ে ভূমির উপরিস্তরে চলে আসে। তখন জমির উপরিস্তর লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া মনুষ্য সৃষ্ট কারণেও লবণাক্ততা বাড়ে। চিংড়ি চাষের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাঁধ কেটে ঘের এলাকায় লবণপানি উত্তোলন করেন। এতে গুটি কয়েক ঘের ব্যবসায়ী লাভবান হলেও এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দার জীবন-জীবিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দুর্বল পোল্ডার ও স্লুইসগেট যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে সময়ে-অসময়ে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করে। উপকূলীয় এই জনগোষ্ঠী তাই জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার আশা হিসেবে তাকিয়ে থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগের দিকে।
পানিকে মৌলিক অধিকার এবং জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে চিহ্নিত করে এই খাতে প্রয়োজনীয় ন্যায্যতাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকা, লবণাক্ত ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানি নিশ্চিতকরণে ব্যাপক কর্মসূচি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। উপকূলীয় এলাকার জমিতে লবণাক্ততা ঢোকা বন্ধে সমাধান বের করতে হবে। এছাড়া জলবায়ুসহিষ্ণু প্রযুক্তির প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি এই খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। উপযুক্ত আকারের বাঁধ স্থাপনের মাধ্যমে লবণাক্ত জলের স্রোতে জমি রক্ষা করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত আকার উচ্চ জোয়ার স্তর থেকে এক মিটার উঁচু হওয়া উচিত। এছাড়া, অতিরিক্ত জল অপসারণ এবং উচ্চ জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানিতে প্রবেশ রোধ করার জন্য বাঁধ ব্যবস্থায় স্লুইসগেটের ব্যবস্থা করা দরকার। অগভীর ভূগর্ভস্থ জলের টেবিলগুলোসহ নিম্ন পাত্রে জলাবদ্ধতা জমে যাওয়া রোধ করতে এবং অতিরিক্ত পানির অভিন্ন নিকাশনের সুবিধার্থে জমি সঠিকভাবে সমতল করা উচিত। সেই সঙ্গে সব নদী দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করে বিলীন হয়ে যাওয়া নদীপথগুলো আবারও প্রশস্ত করার মধ্য দিয়ে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া, সরকারি পর্যায়ে বড় রকমের প্রকল্প হাতে নিয়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। গভীর পুকুর খনন করে এবং সেগুলোর চারপাশে যথাযথ উঁচু বাঁধ নির্মাণ করে লবণাক্ত পানি প্রবেশে বাধা দিয়েও মিষ্টি পানি নিশ্চিত করা যায়। এতে শুধু বর্ষার পানি জমা হবে। এছাড়া সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপ যেমন—বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বড় বড় রিজার্ভার সরবরাহ করা যেতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি পাড়া ও গ্রামভিত্তিক এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে।
পানি দিবসে আমাদের সবার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। পানি যাতে দূষিত না হয়, সেই উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমিয়ে ভূপৃষ্ঠের পানি গৃহস্থালিসহ অন্যান্য কাজে যাতে সর্বাধিক ব্যবহার করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ এক্ষেত্রে অনুসরণ করা যায়। সমুদ্র ও নদ-নদীকেও দূষণের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। শিল্প ও রাসায়নিক বর্জ্য যাতে নদী ও সাগরে না ফেলা হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে পানি অধিকার বিষয়ক আইন রয়েছে। পানির অধিকার যেমন সবার রয়েছে, তেমনি পানির অপচয় ও অপব্যবহার রোধ করা সবারই দায়িত্ব।