শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।—প্লেটোর উল্লিখিত উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হয়। ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যাশা থাকে প্রতিষ্ঠানের সব ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ, শিক্ষকবৃন্দের স্বতঃস্ফূর্ত পাঠদানের মাধ্যমে আত্মার উৎকর্ষ সাধন এবং ক্যারিয়ার গঠনে কার্যকরী হিসেবে গড়ে ওঠা; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, শিক্ষার্থীরা যখন হাজারো প্রত্যাশা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয় এবং প্রত্যক্ষ করে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকার বিষয়ে অবহেলা এবং উদাসীনতা প্রকাশ করছে, তখন শিক্ষার্থীদের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও সোনালি স্বপ্নগুলো হতাশায়, আফসোস এবং অসন্তুষ্টিতে পরিণত হয়।
সম্প্রতি, রমজান মাস উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন, ডাইনিং ও ক্যাফেটেরিয়ায় ইফতার এবং সেহরির খাবারের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষার্থীরা একরাশ হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বরাবরই খাবারের মান নিয়ে বিতর্ক তো রয়েছেই পাশাপাশি পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করা কতটা যৌক্তিক? একজন শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করার দরুন আশপাশের বিভিন্ন হোটেলের মালিকরাও খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করছে এবং অজুহাত পেশ করছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিজেদের হিমশিম অবস্থার জন্য আপনাদের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করেছে, সেখানে আমরা মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তো আরো করুণ। যেখানে সেহরির খাওয়ার শেষ সময় ৪টা ৪০ পর্যন্ত, সেখানে ভালোমানের খাবার পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। লাইনে দাঁড়াতে একটু দেরি করলে কপালে ডাল-ভাজি ছাড়া আর কিছুই জুটে না বললেই চলে। এ ছাড়া অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও খাবারের দাম রাতারাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্বমূল্যের তুলনায় বর্তমানে প্রতি আইটেমে ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাবির মাস্টার দা সূর্য সেন হলের ক্যান্টিনে ৬৫ টাকার গরুর মাংসের দাম বেড়ে এক লাফে ৯০ টাকায় দাঁড়িয়েছে । পাশাপাশি চিংড়ি মাছ ৫০ থেকে ৮০ টাকা, দেশি পুঁটিমাছ ৫০, ব্রয়লার মুরগির মাংস ৫৫, রুই মাছ ৪০ এবং কাতলা মাছ ৪৫ টাকা থেকে এক রাতেই ৭০ টাকা হয়ে গেছে। একদিকে দাম বাড়ছে, অন্যদিকে মাছ-মাংসের টুকরো আরো ছোট হয়ে আসছে। এতে শিক্ষার্থীরা নিশ্চিতভাবে খাবারের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খাবার সমস্যার পাশাপাশি আরো কত যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত টিউশন ফি, সেশনজট, শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট্ট ছোট্ট শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, আবাসন সমস্যা, গণরুম বা গেস্টরুমে তথাকথিত ম্যানার শেখানো, হলগুলোতে অপর্যাপ্ত রিডিংরুম এবং অস্বাস্থ্যকর শৌচাগারসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। উল্লেখ্য, এসব সমস্যা সমাধান ও কাঙ্ক্ষিত অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন, অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন, অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে। এমনকি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অনশন ধর্মঘট পর্যন্ত পালন করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
কিন্তু তার পরও ন্যায্য অধিকার প্রদানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামান্য পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে, একদিকে শিক্ষার্থীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন করবেন, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন তাদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপও করবে না। এভাবে চলমান থাকছে শিক্ষার্থীদের অধিকারের আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যেখানে শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার প্রদানে ব্যর্থ সেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে তা কতটা সফল? তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে অবগত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ের দিকে নজর দেওয়া যাক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সেরা ১ হাজারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো অবস্থান নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ৫০০-তে জায়গা করে নিয়েছে। কিউএস মূলত ছয়টি সূচকে মোট ১০০ নম্বরের ওপর ভিত্তি করে র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। এর মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি ৪০, চাকরির বাজারে সুনাম ১০, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ২০, শিক্ষকদের গবেষণা ২০সহ আন্তর্জাতিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১০ ধরা হয়। প্রত্যেকটি সূচকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে রয়েছে যার দরুন র্যাংকিং পেছনে থাকে ।
বাংলাদেশের সরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নানাবিধ সমস্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারের বরাদ্দকৃত অপর্যাপ্ত বাজেটও ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। সাধারণত একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ কিংবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। অথচ আমাদের দেশে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।
যখন একটি দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পর্যায়ে এমন অবহেলা এবং উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায় তখন সে দেশ কীভাবে উন্নয়নশীল দেশ থেকে স্মার্ট দেশে পদার্পণের স্বপ্ন দেখে এটা আমার বোধগম্য হয় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতসহ শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের সিঁড়িতে পা রাখুন। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মাধ্যমে পরিণত হবে।