ব্যর্থতার গ্লানি দূর হয়নি বন্ধু শিকে কাছে পেয়েও! অর্থাৎ, পরিষ্কার হিসাব—বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন পুতিন, তা যে তার হতাশার বহিঃপ্রকাশ—এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই!
প্রতিবেশী বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আবারও ‘পারমাণবিক ভীতি’ প্রদর্শনের রাস্তায় নেমেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুংকার দিয়ে আসছেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় কয়েক দিন আগে মিত্র দেশ বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দেন তিনি। এ নিয়ে স্বভাবতই ভীতি ছড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু আসল সত্য হলো, পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের এ হুমকি পশ্চিমা নেতাদের ভয় দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। পশ্চিমা বিশ্বের ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্যই এ ‘ইদুর-বিড়াল খেলা’র পথ ধরেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হতাশা থেকেই যে পুতিন এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, তা আর নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার নেই! এমনকি রাশিয়ার হাতে যে খুব একটা ‘বিকল্প’ নেই, তা-ও এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন করে প্রমাণিত হলো।
বর্তমানে সবার জানা, গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরু করার পর থেকে পুতিন লাগাতার পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের আশ্রয় নিয়ে চলেছেন। আক্রমণ শুরুর প্রথম দিক থেকেই রুশ পারমাণবিক বাহিনীকে ‘বিশেষ সতর্ক’ অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে ঘোষণা করতে থাকেন তিনি। এর পেছনে উদ্দেশ্য, পারমাণবিক ভীতি ছড়িয়ে পশ্চিমা শক্তিকে ধন্দে ফেলে যুদ্ধের ময়দানে ফায়দা হাসিল করা। যদিও কিছুদিন পরই পুতিনের এ ‘চোর-পুলিশ খেলা’ ধরে ফেলেন সবাই। বিভিন্ন পক্ষ ভালোমতোই বুঝতে পারে, পশ্চিমা হস্তক্ষেপকে থামানোর প্রচেষ্টা হিসেবেই পুতিনের এই ভ্লামি, ধাপ্পাবাজি!
আমরা দেখেছি, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পুতিনের মুখ থেকে অনবরত ‘পারমাণবিক হুমকি’ আসতে থাকে। এর পেছনে পুতিনের উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমা পক্ষকে চাপে রেখে রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণ বাড়ানো। সে সময় যুদ্ধবাজ পুতিনকে বারংবার ‘বিধ্বংসী অস্ত্র’ ব্যবহার করার ঘোষণা দিতে দেখা গেছে। যুদ্ধে জিততে ‘সম্ভাব্য প্রতিটি উপায়’ ব্যবহার করা হবে বলেও প্রচার করতে দেখা গেছে তাকে। বস্তুত, যুদ্ধক্ষেত্রে করুণ অবস্থা ও রাশিয়ান সেনাদের লজ্জাজনক পশ্চাদপসরণ ঢাকতেই এ বৃথা প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হন পুতিন, যা ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
শুধু এবার নয়, শুরু থেকেই পুতিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছেন—‘আমি ধোঁকা দিচ্ছি না। রাশিয়ার ভূখণ্ডকে (সার্বভৌম ইউক্রেনকে নিজের অংশ মনে করে রাশিয়া) মুক্ত করতে নিজের সব শক্তি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবে ক্রেমলিন।’ যাহোক, নতুন করে পারমাণবিক ভীতি ছড়ানো পুতিনের কাছে যুতসই বিকল্প নেই। পরিষ্কার হিসাব হলো, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে বেশকিছু মিত্র দেশ। কিয়েভকে অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক যুদ্ধ ট্যাংক ও জেট ফাইটার সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে পশ্চিমা মিত্ররা। বলা বাহুল্য, এতে বেশ চাপে পড়ে গেছেন পুতিন। মূলত এ কারণেই তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন। সম্প্রতি ইউক্রেনকে অ্যান্টি-ট্যাংক গোলাবারুদ সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটেন। এ সিদ্ধান্তকে ‘রেড লাইন অতিক্রম করার শামিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন পুতিন, যা তার নতুন বাহানা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এদিকে, ইউক্রেনে কোণঠাসা অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারছে না রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। রুশ বাহিনীর ক্রমাবনতি অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনের বেসামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে বোমা ছোড়ার মধ্য দিয়ে যে বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরির নীলনকশা করে রাশিয়ান বাহিনী, তা আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত। এই বছরের শুরুর দিক থেকেই দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনে থেমে থেমে রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণ চলছে বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থই বলতে হয়। এ দাবির পেছনে যুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে পোস্ট করা ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ান সেনাদের কৌশল খুব একটা কাজে আসছে না। রুশ সেনাদের নিয়মিত প্রাণহানির চিত্রও লক্ষ করার মতো—রুশ সেনা বহরে লাশের সারি ক্রমাগতভাবে দীর্ঘতর হচ্ছে! সামনের দিনগুলোতে রাশিয়ান সেনাদের ঘুরে দাঁড়ানোর তেমন একটা সম্ভাবনাও চোখে পড়ে না। কারণ, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা শক্তির সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ছেই। তাছাড়া ইউক্রেনের প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিশ্রুতি ও সমর্থনও ক্রমশ বাড়ছে, যা জেলেনস্কিকে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী করে তুলছে। মাস দুয়েক আগে জেলেনস্কি লন্ডন, প্যারিস ও ব্রাসেলস সফরে গেলে বীরোচিত অভিবাদন পান। এর কয়েক সপ্তাহ পর স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন সফর করে ইউক্রেনীয়দের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে নিজের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। গত মাসের মাঝামাঝি আরো বড় ধাক্কা খায় রাশিয়া। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। এর ফলে দেশে-বিদেশে পুতিনের অবস্থান যারপরনাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি মিত্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উজ্জীবিত করতে পারেনি পুতিনকে! ব্যর্থতার গ্লানি দূর হয়নি বন্ধু শিকে কাছে পেয়েও! অর্থাৎ, পরিষ্কার হিসাব—বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন পুতিন, তা যে তার হতাশার বহিঃপ্রকাশ—এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই!
এটা এখনো পরিষ্কার নয়, ইউক্রেনে সামরিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে রাশিয়া ঠিক কী কৌশল আঁটছে। ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা সম্প্রতি ‘সামরিক উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে’ বলে সবাইকে বলে বেড়ানো শুরু করেছেন। রুশ কর্মকর্তাদের এ প্রচেষ্টা গুজব বই আর কিছুই নয়! ঝিমিয়ে পড়া রাশিয়ান বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধির জন্য এটা ক্রেমলিনের অব্যাহত প্রচেষ্টার অংশ মাত্র! যাহোক, ক্রেমলিন যত কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন, ইউক্রেনের মাটিতে বিজয় পুতিনের জন্য অধরাই থেকে যাবে। এর কারণ, রাশিয়া যে পথে হাঁটছে তা ‘বাস্তবতার বিপরীত’! যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি জানিয়েছে, ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ব্যবহৃত অস্ত্রভান্ডারই এখন রাশিয়ার সম্বল। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে একেই গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন মনে করছেন পুতিন। কিন্তু অত্যাধুনিক ‘পশ্চিমা প্রযুক্তি’ ও ইউক্রেনের উজ্জীবিত বাহিনীর সামনে সেকেলে অস্ত্র সরঞ্জামসহ ধুঁকতে থাকা রাশিয়ান বাহিনীর অবস্থা কেমন হবে, তা সহজেই অনুমেয়। মুখে যাই বলুন না কেন, এ সত্য অজানা নয় পুতিনেরও। মূলত এ কারণেই নতুন করে ‘পারমাণবিক কার্ড’ খেলছেন পুতিন!
তবে এ কথাও বলে রাখা দরকার, ‘পুতিনের পারমাণবিক হুমকি ফাঁপা হতে পারে’—এ কথা জানার পরও তাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। যুদ্ধে যতই নাস্তানাবুদ হতে থাকবেন পুতিন, পারমাণবিক হুমকি ততই বাড়াবেন তিনি। চূড়ান্ত পর্বে যখন তিনি বুঝতে পারবেন, সব সম্ভাবনা একে একে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন সর্বহারা পুতিন যে কোনো কিছু করে বসতে পারেন! একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই ‘পুতিনের ভয় দেখানোর কৌশল’কে সফল হতে দেওয়া যাবে না। যদি ‘পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল’ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পুতিন কোনোভাবে সফল হয়ে যান, তবে পরাজয়ের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠবেন তিনি। এক্ষেত্রে নিজের খেয়ালখুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করে বসতে পারেন তিনি, যা হবে বিশ্বের জন্য বড় বিপদের কারণ। সব থেকে বড় ভয়, নিরাপত্তার প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী বিধ্বংসী পরিণতি ডেকে আনতে পারে ‘পারমাণবিক হুমকি’। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্বাভাবিক উপাদান হয়ে উঠতে পারে ‘পারমাণবিক ভীতি’। ইউক্রেনের মতো করুণ ভাগ্য এড়াতে বিশ্বের দেশগুলো নিজস্ব পারমাণবিক শক্তি অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। অস্ত্রাগার নির্মাণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ, পুতিনের পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল ঠেকানোর কোনো বিকল্প নেই।
বেলারুশে পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণায় তথা ‘পুতিনের পারমাণবিক ভীতি ছড়ানো’র বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও ন্যাটো বেশ সরব। ইইউ পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল একে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘পরমাণু হুমকির নতুন প্রচেষ্টা’ বলে উল্লেখ করেছে। সম্ভবত সবচেয়ে উপযুক্ত মন্তব্য এসেছে কিয়েভের কাছ থেকে—ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক বলেছেন, ‘পুতিনের পরিকল্পনা প্রমাণ করে, ইউক্রেনে পরাজয়ের ভয় পান তিনি। এবং এক্ষেত্রে ভীতি ছড়ানোর কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নেই তার হাতে!’
যাহোক, খুব ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে, সম্ভবত আগামী মাসে পুতিনের পক্ষ থেকে এ ধরনের ভীতিকর কৌশল ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়তে দেখব আমরা। কারণ, সামনের দিনগুলোতে রাশিয়ান বাহিনীর অবস্থা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় খারাপ হতে পারে। সেই অবস্থায় আরো খ্যাপাটে হয়ে উঠবেন পুতিন। চূড়ান্ত সামরিক পরাজয়ের আশঙ্কার মুখে নিশ্চিতভাবেই পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের মাত্রা বাড়াবেন তিনি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাপী ভীতি বাড়বে, বাড়বে অস্থিরতা। বিঘ্নিতি হবে বিশ্বশান্তি। এমতাবস্থায়, বিশ্বকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে যে নীলনকশার বাস্তবায়ন করতে চাইছেন পুতিন, তা রুখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।