কেন আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি? শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্ন সবার মনে আসাটাই স্বাভাবিক। কেন আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়? এর উত্তর হয়তো বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে দেবেন। আমরা জানি, শিক্ষা মানুষকে সমাদৃত করে, মানুষের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত করার জন্য কাজ করে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী করে গড়ে তোলা। কিন্তু এ কথা আবার সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী হিসেবে সমাজে সমাদৃত হয়ে আছেন সম্মানের পাত্র হিসেবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্বশিক্ষাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কেননা, শিক্ষিত হলেই যে একজন মানুষের ভেতরের ভালো ভাবনাগুলো জাগ্রত হবে, সেটাও ঠিক নয়। শিক্ষার আরো একটি কাজ হলো মানুষকে আলোকিত করা, আলোকিত সমাজ গঠন করা। আবার অনেক অশিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে আমরা শিক্ষিত একজন মানুষের চেয়েও বেশি মেধা ও মননশীল গুণাবলি খুঁজে পেতে পারি।
পৃথিবীতে অনেক মনীষী আছেন, যাঁরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রথাগত যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তাতে প্রকৃত সৃজনশীল প্রতিভাধর মানুষ তৈরি হচ্ছে খুব কম। এর মূল কারণ হচ্ছে, মননশীলতা ও উন্নত চিন্তাধারা সৃষ্টির বিষয়টি পুরোপুরি অবহেলা করা হয়েছে বা কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন, তা হলো শিক্ষা যে গবেষণার বিষয় হতে পারে, সে ধরনের মনোভাব এখনো পর্যন্ত আমাদের মধ্যে খুব একটা গড়ে ওঠেনি বা এই প্রবণতা খুব একটা তৈরি হয়নি। শিক্ষা নিয়ে আর হেলাফেলা করার দিন নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। একটি জাতি শিক্ষায় যত উন্নত, সে জাতির উন্নতির মাত্রাও তত বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে, তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার। সেখানে শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি পিতামাতার দায়িত্ব রয়েছে, নাগরিক সমাজের ভূমিকা রয়েছে, তেমনি প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে খারাপ পরিস্থিতি আছে, তা থেকে আমাদের বের হয়ে আসার রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি সম্মিলিত প্রয়াস। আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা চলছে, শিক্ষাও কিন্তু এর বাইরে নয়। দিন যত যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই নাজুক হচ্ছে। সবাই মিলেই এই অস্থিরতা ও ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।
শিক্ষা খাতে পাশের হার বাড়লেই শিক্ষার মান বাড়ে না। মান বাড়াতে শিক্ষাকে কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণার ক্ষেত্রে যে সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার, তা তারা একধরনের অপব্যয় হিসেবে চিন্তা করে। ফলে একমাত্র সরকারই আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে। আর এ ধরনের সম্পর্ক যদি গড়ে তোলা যায়। তবে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের যে ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা ত্বরান্বিত হবে।
একজন শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আরো উপাদান রয়েছে, তা তার অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে তার মধ্যে কল্পনাশক্তির বিষয়টি গৌণ হয়ে যাচ্ছে। আর যখন কল্পনাশক্তি তৈরি হচ্ছে না, তখন প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ তৈরির বিষয়টি মুখ্য না হয়ে গৌণ হয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত ও উদার চিন্তাধারা না থাকায় একধরনের আজগুবি চিন্তাধারার যান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রকৃত ও নিজস্ব কল্পনা এবং চিন্তাশক্তি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে না।
শিক্ষিত হয়ে মানুষ যদি শিক্ষাকে কাজে না লাগায়, নিজের শিক্ষাকে দুর্নীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, সে ক্ষেত্রে শিক্ষা তার সফলতার দ্বার উন্মোচন করতে পারে না। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করতে পারে না, মানুষের চেতনাবোধকে জাগ্রত করতে পারে না। এখানেই শিক্ষা গ্রহণের ব্যর্থতা। অবশ্য মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে কীভাবে তা কাজে লাগায় তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার সফলতা ও ব্যর্থতা।
সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো প্রযুক্তি বিকাশের প্রথম পর্যায়ে এই বৈষম্য থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে বেকারত্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বিপাকে পড়েছে। ফলে এসব মানুষ খাদ্যব্যয় কমিয়েছেন, যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশির ভাগ মানুষই আশাহত। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবিকার সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কোন খাতে কেমন দক্ষতা প্রয়োজন, আগামী ২০ বছরে কোনো খাতের বিকাশ কেমন হবে, তার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে বেসরকারি খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মীর জোগান দেওয়া যাবে না।
এখনই দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মীর অভাব রয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে কর্মের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য দরকার আগাম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কর্মসংস্থানের গতি কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে জীবিকার সংকট তৈরি হচ্ছে। শ্রমের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার কারণে বেসরকারি খাতে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হয়নি বললেই চলে। সরকারি খাতেও খুবই কম চাকরির সংস্থান হয়েছে।
প্রতি বছর গড়ে ২৬ থেকে ২৭ লাখ লোক নতুন করে শ্রমের বাজারে আসে। এই হিসাবে দুই বছরে এসেছে ৫২ থেকে ৫৪ লাখ লোক। এদের বেশির ভাগেরই কর্মসংস্থান হয়নি। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৭ সালে। ঐ জরিপ অনুযায়ী মোট শ্রমশক্তির মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। বাকি ২৭ লাখ বেকার। ২০২৩ সালেও কর্মসংস্থান করাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরিতে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ, আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ১০ বছরে কোন শিল্প খাতে কেমন কর্মী দরকার হবে এবং কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন পড়বে—এই প্রজেকশন না থাকলে, শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক গ্র্যাজুয়েট তৈরি হবে, কিন্তু চাহিদামতো কর্মী তৈরি করা সম্ভব হবে না।
ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ, প্রতি দুই জনে এক জন বেকার। এই মুহূর্তে ১৮-২৮ বছর বয়সি যে সংখ্যক যুবক আছেন, তাঁদের তিন জনে এক জন বেকার। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার কম। উল্লেখ্য, গার্মেন্টসে চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে গার্মেন্টসে এখন অনেক বিদেশি কর্মী উচ্চ পদে কাজ করেন। উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অভিজ্ঞ কর্মী তৈরি করাটা এখন জরুরি। আলোকিত সমাজ গঠনে চাই সঠিক শিক্ষা, যে শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করবে। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। পরনিন্দা, পরচর্চা বাদ দিয়ে উদারনৈতিক ও পরমতসহিষ্ণু মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই।