১৯৩০ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে, কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অফিসের সামনে এক বাঙালি স্কুল শিক্ষক দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাম রাহমত আলী। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি কালো বাঁধাই করা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট, যার ওপর স্পষ্টভাবে লেখা ছিল ‘British Subject’। তবে তিনি কোনো বিদেশ যাত্রার অপেক্ষায় ছিলেন না। এই পাসপোর্ট ছিল তাঁর হাতে তুলে দেওয়া এক নৈতিক অধিকার, হাজারো নিপীড়িত কৃষকের হয়ে সত্য উচ্চারণের অধিকার। তাঁর এই যাত্রা ছিল না ভৌগোলিক, বরং ন্যায়বিচারের পথে এক প্রতীকী অগ্রযাত্রা।
রাহমত আলীর শেকড় পাবনা জেলার এক কৃষক সমাজে। সেই সমাজ বহু আগেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে “পাবনা ভাড়াটে বিদ্রোহ” (১৮৭৩–৭৬) এর মধ্য দিয়ে। জমিদারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কৃষকেরা তখন শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর ফলেই ১৮৮৫ সালে পাস হয় বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, যা কিছুটা হলেও ভাড়াটেদের অধিকার নিশ্চিত করে।
ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমের মিথ্যাচার
১৯৩০ সালে নীল চাষের নিপীড়নের কথা আর চাপা ছিল না। ব্রিটিশরা নীল গাছ চাষে কৃষকদের বাধ্য করতো, যা খাদ্য ফসলের জায়গা দখল করে নিত। এতে কৃষকরা দরিদ্র, ঋণগ্রস্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে পড়তেন। এই শোষণের বিরুদ্ধেই রাহমত আলীর লড়াই। তিনি যাত্রার আগে দেখা করেন একজন বর্ষীয়ান আইনজীবীর সঙ্গে, মাওলভী আজহার আলী মিঞা। তিনি পাবনার শাতবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী একজন প্রখ্যাত মুসলিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। কলকাতা হাইকোর্টের অভিজ্ঞ প্লীডার হিসেবে সুপরিচিত আজহার আলী মিঞা ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির পাবনা পূর্ব (গ্রামীণ) মুসলিম কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। মাওলভী আজহার আলী মিঞা ১৯৩৭ সালের অফিসিয়াল বেঙ্গল বিধানসভা রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত আছেন।
- সূত্র: Bengal Legislative Assembly Proceedings, 1937, archive.org
- সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য তালিকা, lalib.wb.gov.in
তিনি রাহমত আলীকে বলেছিলেন: “তুমি সত্যের সন্ধানী এক ভূমির সন্তান। স্পষ্টভাবে কথা বলো। তোমার হাতে যে সত্য আছে, তা গুরুত্বপূর্ণ।” রাহমতের এই লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ান এলিজা মার্টিন, The Statesman-এর এক তরুণী ব্রিটিশ সাংবাদিক। The Statesman ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, যা কখনো কখনো গ্রামীণ ভারতীয়দের দুর্দশার চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরত। যদিও সম্পাদক তাঁকে নিরপেক্ষ থাকতে বলেছিলেন, রাহমতের বয়ান এবং শত শত গ্রামবাসীর চিঠি পড়ে তিনি আর নিরব থাকতে পারেননি এলিজা রাহমতের সঙ্গে পাবনায় গিয়ে নিজ চোখে দেখেন নীল চাষের ভয়াবহতা। তিনি সাক্ষাৎ করেন আমিনা বেগম নামের এক বিধবার সঙ্গে, যাঁর স্বামী চুক্তিভিত্তিক নীল চাষে নিপীড়নের ফলে মারা যান। তিনি শিশুদের হাতের উপর নীল দাগ, ফাঁকা খাদ্যভাণ্ডার, ক্ষুধার্ত চাষির চোখ দেখেন। একজন হিন্দু পুরোহিত স্বীকার করেন: “আমি কখনও ভাবিনি, নীল এতটা বিষ হয়ে উঠবে।”
এই অভিজ্ঞতা থেকে এলিজা মার্টিন The Statesman-এ একটি প্রতিবেদন লেখেন— শিরোনাম ছিল: “Blood of the Indigo Fields” (বাংলা: নীল ক্ষেতের রক্ত)। প্রতিবেদনটি কলকাতা ছাড়িয়ে পৌঁছায় লন্ডনের ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টেবিলে। প্রতিবেদনটি প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল বিষয়টি চেপে রাখতে, কিন্তু এলিজা ও রাহমতের সংগ্রাম সত্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। ফলে ১৯৪০-এর দশকের শুরুতেই জোর করে নীল চাষ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এই পটভূমির মাঝে রাহমত আলীর সেই পাসপোর্ট কখনো ব্যবহৃত হয়নি বিদেশযাত্রার জন্য। তবুও তার প্রতিটি পৃষ্ঠা ছিল বাঙালির দুঃখ ও প্রতিরোধের ইতিহাসের নিরব বাহক।
তাঁর এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ সেই পাসপোর্ট এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছেন এক চিরন্তন বার্তা। নিরুদ্দেশ ইতিহাসের স্মৃতি এখনো জীবিত—জনশ্রুতি জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাবনারই এক পাঠক জানিয়েছেন: “আব্বার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। আমাদের পাড়ায় নীল কুঠির সাহেবের বড় একটি প্রাসাদ ছিল। বাড়ির পাশের গলির নাম ছিল ‘হাউজ পাড়া’। সেখানে বিশাল বিশাল হাউজ ছিল, যেখানে নীল গাছ ভিজিয়ে রাখা হতো। আমি নিজেও সেই প্রাসাদ ও হাউজের কিছু অংশ দেখেছি। সরকার এগুলো রক্ষা করেনি। বাড়িটি সম্ভবত ১৯৮৭/৮৮ সালের দিকে দখল করে ভেঙে ফেলা হয়। হাউজ পাড়ার অনেক বাড়িতে তখনকার বড় বড় ইটের তৈরি হাউজের কিছু অংশ এখনও বাড়ির আঙিনার ওয়াল হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে।” এই মন্তব্য প্রমাণ করে, ইতিহাস শুধু বইয়ে নেই—মানুষের স্মৃতিতে এখনও তা জ্বলজ্বলে।
তথ্যসূত্র ও প্রাসঙ্গিক পটভূমি:
নীল চাষ:
- কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্যিক রঞ্জন গাছের চাষ, খাদ্য উৎপাদনের বিপরীতে ব্যবহৃত হতো।
- পাবনা ভাড়াটে বিদ্রোহ (১৮৭৩–৭৬): জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ কৃষক আন্দোলন।
- বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট ১৮৮৫: কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণীত আইন।
- মাওলভী আজহার আলী মিঞা (১৮৮০–১৯৬১): পাবনার শাতবিলা গ্রামের প্রখ্যাত মুসলিম আইনজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ১৯৩৭ সালের বেঙ্গল বিধানসভা সদস্য।
- The Statesman: ব্রিটিশ ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, যা কখনো কখনো গ্রামীণ বঞ্চনার চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরতো।
সূত্রসমূহ:
- Bengal Legislative Assembly Proceedings, 1937, archive.org
- পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য তালিকা, lalib.wb.gov.in
লেখকঃ – মঈন কাদেরী -ব্রিটিশ বাংলাদেশী মেয়র লন্ডন বরো অব বার্কিং এন্ড ডাগেনহ্যাম।