ইউক্রেন দখলের দায়িত্ব ওয়াগনার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। এখন তাদের ‘বন্দুকের নল’ ঘুরে গেছে তারই দিকে। দ্রুতগতিতে মস্কোর দিকে ধেয়ে যায় রুশ ধনকুবের ব্যবসায়ী অলিগার্চ ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের ভাড়াটে যোদ্ধার দল। শনিবার ইউক্রেন সীমান্তবর্তী রাশিয়ার একটি শহর দখলে নেয় ওয়াগনার গ্রুপ। মস্কো যেতে সময় লাগত মাত্র ছয় ঘণ্টা। কিন্তু হঠাৎ করেই অভিযান বন্ধ করার ঘোষণা দেন প্রিগোশিন। শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ালেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর জন্য এটা ছিল ভয়ানক হুমকির। শনিবার দিনটা পুতিনের জন্য ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয়। তবে এটা পুতিনের দুর্বল হওয়ার বহিঃপ্রকাশ, নাকি পুতিনের কৌশল, তা নিয়েই আলোচনা চলছে বিশ্বগণমাধ্যমে।
কারাগার থেকে হটডগ, পুতিনের বাবুর্চি : ১৯৬১ সালে জন্ম নেওয়া প্রিগোশিন সেইন্ট পিটার্সবার্গে বড় হয়েছেন। তিনি সোভিয়েত আমলে ডাকাতি ও প্রতারণার জন্য কারাগারে কাটিয়েছেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। আর প্রিগোশিনেরও উদ্যোক্তা হওয়ার পথ খুলে যায়। তিনি নিজের শহরে হটডগের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ে মনোযোগ দেন। ঐ রেস্তোরাঁ ছিল রুশ ধনীদের খাওয়া ও আড্ডার কেন্দ্রস্থল। ঐ সময় স্থানীয় ডেপুটি মেয়র পুতিনেরও আড্ডা ও খাবারের মূল কেন্দ্র ছিল এই পানশালাটি। প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় অল্প দিনেই ফুলেফেঁপে ওঠেন প্রিগোশিন। বিশেষ করে, পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সরকারি খাবার সরবরাহের চুক্তি পায় নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত প্রিগোশিনের ক্যাটারিং সার্ভিস কনকর্ড। পুতিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সেইন্ট পিটার্সবার্গে আগমনের সময় খাবার সরবরাহ তাকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তিনি পুতিনের এমন ঘনিষ্ঠ হন যে, তার ডাকনাম হয়ে যায় ‘পুতিনের বাবুর্চি।’ কিন্তু প্রিগোশিনের আকাঙ্ক্ষা থেমে থাকেনি। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের কথাও তিনি পরে স্বীকার করেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ওয়াগনার গ্রুপ গড়ে তোলার কথা স্বীকার করেন ২০২২ সালে এসে। ক্রিমিয়া থেকে আফ্রিকা ও সিরিয়ায়ও যুদ্ধ করেছে তার এই গ্রুপ।
কীভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো : ইয়েভগেনি প্রিগোশিন প্রেসিডেন্ট পুতিনের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং পুতিনের অধীনেই তার উত্থান ঘটেছে—প্রথমে একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী এবং তার পরেই তিনি এই ভাড়াটে বাহিনীর প্রধান হয়েছেন। ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় বাখমুত শহর দখলের লড়াইয়ে ওয়াগনার গ্রুপের বহু যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। কয়েক মাস ধরে সেখানে তীব্র যুদ্ধ চলার পরেও ঐ এলাকা পুরোপুরি দখল করে নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রিগোশিন প্রায়শই রুশ সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন তার বাহিনীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়াতে তিনি মাঝেমধ্যেই ভিডিওসহ বক্তব্য পোস্ট করেছেন, যাতে ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক ব্যর্থতা ও বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে লক্ষ্য করে তিনি কখনো তার ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। তবে তিনি যে কখনো ব্যঙ্গ করে কোনো একজন ‘সুখী দাদার’ কথা উল্লেখ করে থাকেন, তাকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরোক্ষ সমালোচনা হিসেবেই মনে করা হয়। গত ২৩ জুন প্রিগোশিন একটি তিরস্কারপূর্ণ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তিনি রুশ নাগরিকদের উদ্দেশে বলেছেন—ইউক্রেন যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো মিথ্যা। তিনি বলেন, এই যুদ্ধ আসলে সামরিক বাহিনীর ছোট্ট ও অসৎ একটি গ্রুপের নিজেদের পদোন্নতির অজুহাত এবং জনগণ ও প্রেসিডেন্টের প্রতি ভাঁওতাবাজি। প্রিগোশিন বলেছেন, এই যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল…যাতে শোইগু (রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী) মার্শাল হতে পারেন। যাতে তিনি দ্বিতীয় হিরো স্টার পেতে পারেন…ইউক্রেনকে নিসমুক্ত করার জন্য এই যুদ্ধ নয়, আরো একটা স্টারের জন্য এই যুদ্ধ তার দরকার ছিল।
ক্রেমলিনের মাথাব্যথার কারণ : দিন যত গেছে ততই প্রিগোশিনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাটা বড় হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম মেডুজা জানিয়েছে, তিনি রক্ষণশীল ও জাতীয়তাবাদী দল গঠনেরও পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও তিনি সেটি অস্বীকার করেছেন। এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাই ক্রেমলিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি করে। কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রেই কলেসনিকভ জানিয়েছেন, প্রিগোশিনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল তাকে দেওয়া ক্রেমলিনের কাজকে সম্পাদন করা। তিনি কাজ করতে গিয়ে তার বাহিনীতে কারাবন্দিদেরও ঢুকিয়েছেন। এখন তার বাহিনীর ৮০ শতাংশ সৈন্যই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত কারাবন্দি।
পুতিনের কৌশল, না ব্যর্থতা : মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, প্রিগোশিন পুতিনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। কারণ তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে প্রিগোশিনের। সেক্ষেত্রে ‘আয়রনম্যান’ পুতিনের ক্ষমতার ভিত নড়ে গেল। যদিও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এটা পুতিনের কৌশল। তিনি ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিতে এগোচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের কৌশলকে পুরোপুরি মানতে পারছেন না প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাই তিনি ওয়াগার গ্রুপকে মাঠে নামিয়েছেন। প্রিগোশিন যেভাবে সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সমালোচনা করেছে, তা পুতিনের অনুমতি ছাড়া করেছেন, এমনটা মনে হয় না। কারণ রাশিয়ায় সেনা নেতৃত্বের সমালোচনা করার অধিকার একমাত্র পুতিনেরই আছে। পুতিন সেনা নেতৃত্বকেও চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন। আবার যখন দেখেছেন, প্রিগোশিন বেশি বাড়াবাড়ি করছেন তখন তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। আর এই বিদ্রোহ হয়তো সেই কৌশলেরই অংশ। শেষ পর্যন্ত প্রিগোশিনকে বেলারুশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন কখনোই তাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে দেবেন না। তিনি চান, প্রিগোশিন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতেই যুক্ত থাকুন।
তার পরও মনে করা হচ্ছে, ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে এটাই প্রিগোশিনের সরাসরি প্রথম চ্যালেঞ্জ। এর আগে তিনি প্রেসিডেন্টের সম্পূর্ণ অনুগত ছিলেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি আরো অস্ত্রের দাবিতে সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে লড়াই করছিলেন, কিন্তু এখন তিনি এই নেতাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ালেন। রাশিয়াতে প্রিগোশিনের প্রতি জনগণের সমর্থন উল্লেখযোগ্য। এমন কথাও শোনা যায় যে, ক্রেমলিন ও সামরিক বাহিনীর ভেতরেও তার সমর্থক রয়েছে। তার এই চ্যালেঞ্জ যদি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ও, এই ঘটনা রুশ সামরিক বাহিনীর জন্য একটি সংকটের কারণ হয়ে থাকবে। কারণ রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধে এই ভাড়াটে বাহিনীর ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বের বিষয়ে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।