ভ্লাদিমির পুতিনের যৌবনের ব্রেজনেভ যুগে, ৯ মে ছিল সোভিয়েত সামরিকবাদের একটি উপলক্ষ্য, অস্ত্র ও শক্তির উদ্যাপন। দিনটি রাশিয়ার বিজয় দিবস হিসেবে স্বীকৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দিন নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে তারা জয়লাভ করে। তবে অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গেলে চলবে না যে, লিওনিড ব্রেজনেভ আফগানিস্তান যুদ্ধে হেরে যান। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগে ব্রেজনেভ (১৯০৬-১৯৮২) ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ৯ মে উদ্যাপন শুরু করার দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে তারা লড়াই করে হেরে যান। সম্ভবত মিস্টার পুতিন ইউক্রেনে তার শেষ যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে হারতে বসেছেন।
আফগানিস্তান ও ইউক্রেন যুদ্ধ উভয় সংঘাত শুরু হওয়ার সময় পশ্চিমা দেশের মানুষ বোধগম্য কারণে পারমাণবিক যুদ্ধ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আজকের রাশিয়া অবিরামভাবে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়ে চলেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার কথা আলাদা, তবে পশ্চিমা দেশে আজ এগুলো কৌশলগত পরিভাষার পরিবর্তে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আলোচনা করা হয়। মিস্টার পুতিন কী অনুভব করছেন? আমরা কেমন অনুভব করছি? আলোচনার সারবস্তু এটাই।
আমেরিকানদের প্রধান ও বড় ভয় ছিল তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহে কালবিলম্ব করেছে, নয়তো ইউক্রেন গত বছরই জয়ী হতে পারত। একের পর এক বাড়তি অস্ত্র এখন সরবরাহ করা হয়েছে। তবে বিলম্বের কারণে ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া এখন যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে সেগুলোতে। সেই সব অঞ্চল এখন মৃত্যুর গহ্বর, নির্যাতনের চেম্বার এবং অপহৃত শিশুদের খালি ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব অঞ্চলে উভয় পক্ষের কয়েক হাজার সৈন্য অকারণে মারা গেছে।
প্রায় ১৫ মাস ধরে চলছে ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে এই যুদ্ধে রাশিয়ান পারমাণবিক প্রচার এবং পশ্চিমা উদ্বেগ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের কোনো ব্যবহার হয়নি। এটা ব্যাখ্যাতীত। যারা ভেবেছিলেন ইউক্রেনীয়রা প্রতিরোধ করলে, পশ্চিমারা অস্ত্র সরবরাহ করলে বা রাশিয়া পরাজয়ের সম্মুখীন হলে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে, তাদের এই ধারণা এখন পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কৌশলগত চিন্তাবিদেরা প্রতিরোধের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেও রাশিয়া বাস্তবে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে না। কেননা, এর ফলে পশ্চিমা বিশ্ব নাটকীয়ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে এবং এতে রাশিয়ান নেতাদের পরাজয় হবে। তবে এর একটি গভীর ব্যাখ্যা রয়েছে, তা হলো—রাশিয়ার পারমাণবিক আলোচনা করাটাই একটা অস্ত্র।
এই আলোচনাটা একটা মিথ্যা অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ান পারমাণবিক প্রচারণা থেকে অনুমান করা হচ্ছে যে, বুলি সব সময় জয়ী হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বুলি সব সময় জেতে না। রাশিয়ান প্রচারকারীরা আমাদের মনে করিয়ে দিতে চায়, পারমাণবিক শক্তির দেশগুলো কখনোই যুদ্ধে হারতে পারে না। তাদের যুক্তি হলো, জয়ের জন্যই সর্বদা পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক কল্পনা মাত্র। পারমাণবিক অস্ত্র আলজেরিয়ায় ফরাসিদের বিজয় এনে দিতে পারেনি বা এই অস্ত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে পারেনি। পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হয়েও সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান যুদ্ধে হেরে যায়। আমেরিকা ভিয়েতনামে, ইরাক ও আফগানিস্তানে হেরে গেছে। লেবাননে জিততে পারেনি ইসরাইল। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো এখন নিয়মিতভাবেই যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে।
কিছু আমেরিকান একটি পারমাণবিক পরিস্থিতির কথা বলে আসছেন, যার মূল কথা হলো, পরাজয় এড়ানোর জন্য রাশিয়ানরা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে তার নিজের শর্তেই বারবার পরাজিত হচ্ছে। এটি যা প্রমাণ করছে তা হলো, প্রতিটি পরাজয়ের পরে সেই শর্তগুলো রাশিয়ার পরিবর্তন করার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার জন্য ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর সুস্পষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর চেয়ে বড় অপমান আর কিছু নেই। কিয়েভের পরাজয়ের পরে খারকিভ ও খেরসনে আরো পরাজয় ঘটে। প্রতিটি ক্ষতির ফলে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারক এবং তাদের বিশ্বাসীর কাছ থেকে কৌশলগত প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। এতে প্রপাগান্ডিস্টদের কাজের চাপ বেড়েছে।
কোণঠাসা না হয়েও হারতে পারে রাশিয়া। প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়ান নেতারা ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা যদি বিশ্বাস করেন তারা হেরে যাচ্ছেন, তবে তারা কী করবেন:রেফারেন্সের শর্তাবলি পরিবর্তন করুন এবং রাশিয়ান মিডিয়ায় বিষয়টি পরিবর্তন করুন। সামগ্রিকভাবে মিস্টার পুতিনের রাষ্ট্র দুর্নীতিগ্রস্ত এবং এর নির্ভরশীলরা যেমন ওয়াগনার ভাড়াটে সেনাবাহিনী হচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর একটি জনসংযোগ প্রকল্প।
মিস্টার পুতিনের অস্পষ্ট ধারণা হলো, রাশিয়া যদি ন্যাটো দ্বারা আরোপিত ‘কৌশলগত পরাজয়’ এড়িয়ে যেতে পারে, তবেই তারা জয়ী হবে। যা-ই ঘটুক না কেন, তখন ইউক্রেনের যুদ্ধকে কৌশলগত বিজয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা তার পক্ষে সহজ হবে। যেহেতু ক্রেমলিন দাবি করে তারা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাই মিস্টার পুতিনকে বলতে হবে যে রাশিয়া ন্যাটোকে রাশিয়ায় প্রবেশ করা থেকে বিরত রেখেছে। ওয়াগনারের কমান্ডার সম্প্রতি লিখেছেন, এই চেতনায় রাশিয়া যে কোনো সময় ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শেষ করতে পারে এবং দাবি করতে পারে, তার লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে। এভাবে রাশিয়া নতুন কোনো ইউক্রেনীয় অঞ্চল দখল করা থেকে পিছু হটবে।
পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলকে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা আসলে পারমাণবিক যুদ্ধের সামগ্রিক অসম্ভাবনাকে বাড়িয়েছি। যদি পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল রাশিয়ান বিজয়কে নিশ্চিত করে, তাহলে এর পরিণতি হবে অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। পারমাণবিক অস্ত্রধারী কোনো দেশ যদি যা খুশি তাই করতে পারে, তাহলে আইন থাকার কোনো মানে হয় না, এর মাধ্যমে কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এর ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেবে। পরমাণু অস্ত্রবিহীন দেশগুলোকে পরমাণু অন্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলতে হবে এই যুক্তিতে যে, তাদের ভবিষ্যতে পারমাণবিক প্রতিরোধের প্রয়োজন হবে। এভাবে পারমাণবিক বিস্তার ভবিষ্যতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলবে।
যখন আমরা বুঝতে পারি পারমাণবিক আলোচনা নিজেই অস্ত্র, তখন আমরা পরিস্থিতি কম ঝুঁকিপূর্ণ করার জন্য কাজ করতে পারি। কৌশলগত চিন্তাভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উপায় হলো আমাদের নিজেদের উদ্বেগ থেকে নিজেদের মুক্ত করা। রাশিয়ানরা পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে কথা বলে না। এই অস্ত্র তারা ভীতি প্রদানে ব্যবহার করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে একটি বড় পারমাণবিক অস্ত্রাগার তাদের একটি সুপার পাওয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনে। এই অস্ত্র থাকলেই তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে। তারা পারমাণবিক ধমককে তাদের বিশেষাধিকার হিসেবে দেখে। ইউক্রেনীয়রা এই হুমকিকে পাত্তা দেয়নি। তাই এটা তাদের কৌশলকে প্রভাবিত করেনি।
রাশিয়া যখন একটি অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটায়, তখন এর অর্থ হলো তার পরাশক্তির মর্যাদা ক্রমাগতভাবে হারানো, যার জন্য আজ তারা এত ঈর্ষান্বিত। এই ধন একসময় তারা রক্ষা করতে পারবে না। তাদের সেনাবাহিনীকে মারধর করা হয়েছে—এই স্বীকারোক্তি তাদের বিপুল ক্ষতির কারণ হবে। আরো খারাপ অবস্থা তৈরি হবে যদি প্রতিবেশীরা নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরি করে ফেলে। এতে রাশিয়াকে পরাশক্তির মর্যাদা থেকে রাশিয়ানরাই বঞ্চিত করবে। অর্থাৎ, রাশিয়ান নেতৃত্বের জন্য এই ইউক্রেন যুদ্ধ এক অসহনীয় পরিণতি ডেকে আনছে। আমার দৃষ্টিতে, রাশিয়ান পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি সেটাই হবে, যদি মস্কো ইউক্রেনকে জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত ধ্বংসের জন্য দায়ী করে।
যে কোনো যুদ্ধ অপ্রত্যাশিত। সামরিক ইতিহাস বিস্ময়ে ভরা। মিস্টার পুতিন নৃশংসভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। যত দিন যুদ্ধ চলতে থাকবে, তত দিন আরো নৃশংসতা বাড়বে এটা নিশ্চিত। রাশিয়া যখন থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, তখন থেকে কেবল অপ্রয়োজনীয় দুর্ভোগই নয়, অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকিও তৈরি করেছে। আমাদের সেই ঝুঁকি ও ভয়াবহতার জগতে কাজ করতে হবে এবং শান্তভাবে সবকিছু মূল্যায়ন করতে হবে। বিপদ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই; আমাদের দায়িত্ব এই বিপদ যথাসম্ভব কমানো। যখন রাশিয়ানরা পারমাণবিক যুদ্ধের কথা বলে, তখন সবচেয়ে নিরাপদ জবাব হলো প্রচলিত যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত করা।