কাউকে যখন প্রশ্ন করা হয়, সমুদ্র দেখতে কেমন? তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ নীলাভ জলরাশি, বিরাট আকৃতির ঢেউ, যেগুলো আছড়ে পড়ছে তীরে। অথবা যদি প্রশ্ন করা হয়, মরুভূমি কেমন? তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে অত্যন্ত শুষ্ক, বৃষ্টিবিরল ও বালু দ্বারা আবৃত বিস্তীর্ণ এলাকা। পৃথিবীর মানচিত্রে যখন বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প ও মৃশিল্পের সুখকর গল্প। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ যেসব জিনিস নিয়ে গর্ব করতে পারে, তার মধ্যে এসব লোকশিল্প উল্লেখযোগ্য।
পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তনের ধারার সঙ্গে লোকশিল্পের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর প্রাচীন অনেক সভ্যতার নিদর্শনে আমরা মৃশিল্পের ব্যবহার দেখতে পাই। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকশিল্পের ইতিহাসও দীর্ঘকালের। মৌর্য, গুপ্ত, সেন, পাল আমলে আমাদের ছিল গর্ব করার মতো লোকশিল্প। এই শিল্পের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতেন অনেকে। এই শিল্প ছিল রুটি-রুজির প্রধানতম অবলম্বন। পরিবেশবান্ধব লোকশিল্পের পণ্য দামে যেমন ছিল সস্তা, তেমনি ছিল সৌন্দর্যবর্ধক। দুঃখজনকভাবে সেই চিত্র এখন আর প্রায় দেখাই যায় না! আমাদের দেশে এখন চলছে শীত মৌসুম। শীতকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের মেলা। এসব মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে মাটির কলসি, সানকি, সরা বা ঢাকনা, ছোট-বড় তাগার, হুক্কা, বিভিন্ন রকম পুতুল, দেব-দেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনসাঘট, ফুলদানি ইত্যাদি। বাংলাদেশের লোকশিল্পের শিল্পীরা অনেকটাই সহজাত প্রকৃতির। মানুষের যাপিত জীবন, প্রকৃতি থেকে তারা সংগ্রহ করেন তাদের শিল্পের ধারণা। সেই ধারণা ও কল্পনাশক্তি থেকেই তৈরি হয় এসব লোকশিল্প। গ্রামীণ জীবনের নানা দিক ফুটে ওঠে এসব শিল্পকর্মে।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগে লোকশিল্প অনেকটাই বিলুপ্তির পথে—এটা নিতান্ত দুঃখজনক। কালের বিবর্তনে লোকশিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে! মানুষ এখন ঝুঁকে পড়েছে এর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পরিবেশবিধ্বংসী বিভিন্ন পণ্যের দিকে। ফলে হস্তশিল্পের চাহিদা তো কমে গেছেই, পাশাপাশি লোকশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই হয়েছেন বেকার। লোকশিল্প আজ এক রকম বিলুপ্তির পথে। অতীতে বাংলাদেশের লোকশিল্পের ছিল বিপুল চাহিদা। বর্তমান সময়েও এসব লোকশিল্পের রয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। একটা সময় ছিল, যখন মসলিন কাপড়ের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য। বর্তমানে নানাবিধ লোকশিল্পের পণ্যসম্ভার বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে এবং সেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু তা আশানুরূপ নয়। অথচ উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লোকশিল্প থেকে আমরা আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লোকশিল্পে যোগ হবে নতুন মাত্রা।
মানতে হয়, লোকশিল্পে কিছু সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে। লোকশিল্পীদের মেধাস্বত্ব অনেক ক্ষেত্রে রক্ষিত হচ্ছে না। লোকশিল্পের ক্ষেত্রে যথাযথ কপিরাইট, প্যাটেন্ট, ট্রেডমার্ক—এগুলো ব্যবহার উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেই সব দেশে শিল্পীদের মেধাস্বত্ব রক্ষা করার জন্য অনেক আইন আছে। বাংলাদেশেও লোকশিল্পীদের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে—প্রচারেই প্রসার। লোকশিল্প বাঁচাতে হলে ব্যাপক হারে এর প্রচার ঘটাতে হবে। লোকশিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন—বাঁশ, বেত, শণ ইত্যাদি চাষে সংশ্লিষ্টদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে এই খাতে নিয়োজিতদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। লোকশিল্প গবেষণা ও উন্নয়নে আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। এভাবেই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্প আবারও তার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। এতে করে বেকারত্বের হারও কমবে। প্রতি বছর চাকরির বাজারে যে সংকট দেখা যায়, তা কমবে অনেকটাই। লোকশিল্পের যথাযথ প্রসারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দখলের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আমাদের লোকশিল্প আবার বিশ্বের বুকে উজ্জ্বল করবে বাংলাদেশের মুখ।