বই মানুষের পরম বন্ধু। মৌমাছি যেমন ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে একটু একটু করে গড়ে তোলে পূর্ণাঙ্গ মৌচাক, ঠিক তেমনিভাবে একজন লেখকও সমাজ, সংস্কৃতি, বৈশ্বিক ভাবনা, কল্পজগতের নানা বিষয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে টুকরো টুকরো শব্দ দিয়ে রচনা করেন পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। মৌমাছির কাছে মধুর চাক তৈরি করাটাই সাধনার বিষয়। একজন লেখকের জন্যও পরম সাধনার বিষয় একটি মানসম্মত বই রচনা করা।
ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে আমাদের দেশে নানান স্থানে ভাষা শহিদদের সম্মান জানানোর জন্য বইমেলার আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত বইমেলা বৃহৎ পরিসরে মাসব্যাপী সংগঠিত হয়ে থাকে। এই বইমেলায় প্রতি বছরই নতুন নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হয়। যা নিঃসন্দেহে দেশের সৃজনশীল ও মননশীল চিন্তা-চেতনার পরিচয় তুলে ধরে। তবে পরিতাপের বিষয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব লেখকের বই মেলায় স্টলে স্টলে শোভা পেতে দেখা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশ লেখকের সঙ্গে কোনোভাবেই পরিচিত নই আমরা! প্রাণের মেলায় এভাবে গণহারে অজ্ঞাত-অপরিচিত লেখকের বই প্রকাশের হিড়িক কী বার্তা বহন করে?
বর্তমান সমাজব্যবস্থা যতটা না শিল্পনির্ভর, তার চেয়ে অধিক অর্থনির্ভর—এ কথা না মেনে উপায় নেই। এ অর্থনির্ভর পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় একজন সাধারণ ব্যক্তির যেমন অর্থের প্রয়োজন হয়, তেমনি একজন লেখক ও সাহিত্যিকেরও অর্থের প্রয়োজন হয়। এই বিষয়কে সামনে রেখেই যদি অপরিপক্ব লেখকের হাত ধরে যাচ্ছেতাই বইয়ে বাজার সয়লাব হয়ে থাকে, তবে তো বলতে হয়, আমরা এক হতভাগা জাতি! মনে রাখা জরুরি, একজন সাধারণ ব্যক্তির সঙ্গে একজন লেখক বা সাহিত্যিকের বিস্তর ফারাক রয়েছে। সাধারণ ব্যক্তিরা সমাজে সমস্যাসংকট তৈরি করে বা তার পরিপ্রেক্ষিতে খুব কমই প্রতিবাদমুখর হয়। কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে একজন সাধারণ ব্যক্তি অবলীলায় গ্রহণ করলেও লেখক বা সাহিত্যিক সমাজ সমাজের নানাবিধ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। এদিক থেকে বিচার করলে, শুধু অর্থ বা খ্যাতির প্রয়োজনে বই লেখা হয়ে থাকলে তা অতি দুঃখজনক বইকি। লেখক ও সাহিত্যিকরা হলেন সমাজের বিবেক। অর্থের প্রয়োজন সবারই আছে। আছে খ্যাতির বাসনাও। তাই বলে অর্থ বা খ্যাতির পেছনে ছোটা লেখক ও সাহিত্যিকের কলমে অবান্তর সব বিষয় উঠে আসাটা মেনে নেওয়া যায় না কোনোভাবেই।
এবারের বইমেলায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিক্রি হয়নি বই। এজন্য দায়ী করা হচ্ছে অখ্যাত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘নামসর্বস্ব’ লেখকের বইয়ে মেলার স্টল ছেয়ে যাওয়াকে। প্রতি বছর বইমেলা এলেই পাঠকগণ চাতক পাখির মতো প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে পাঠকদের নিরাশ হতে হচ্ছে! এর কারণ, মেলায় বা বাজারে ভালো মানের বই না থাকা! বাস্তবিকভাবে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েক জন লেখক, সাহিত্যিক বাদে অধিকাংশের মূল লক্ষ্য হলো অর্থ ও তথাকথিত খ্যাতি। সমাজের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু কাহিনির সমাহার আর কিছু অতি স্বাভাবিক ঘটনার সংমিশ্রণে অধিকাংশ বই রচিত হতে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে উচ্চমানের কাগজ, গাঢ় কালির রেখা আর উজ্জ্বল চকচকে প্রচ্ছদ। তাছাড়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টা হচ্ছে ‘নাম ও পোস্ট-পদবি’। সব মিলিয়ে আজকের দিনে একজন লেখকের কাছে শিল্পের চেয়ে অর্থ প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জাজনকও।
বলা বাহুল্য, বর্তমানে কিছু লেখক ও প্রকাশনী সংস্থা পাঠকের সঙ্গে এধরনের লুকোচুরি খেলছে, যাকে বলা যায় শুভংকরের ফাঁকি। একজন লেখকের লেখা অবশ্যই অমূল্য। আদর্শ ও মানসম্মত লেখার উপযোগিতা আসেলই অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু তাই বলে অতি নিম্নমানের বই প্রকাশ করে তা পাঠকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জাতির লাভ না ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত। তথাকথিত নব্য লেখকদের ভিড়ে প্রকৃত লেখক, সাহিত্যিক যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যান, সেদিকটাতে ভালোমতো খেয়াল করার সময় এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তো বটেই, পাঠকদেরও এ ব্যাপারে সজাগ ভূমিকা পালন করতে হবে।