মানব সভ্যতার ইতিহাস, প্রবঞ্চনার ইতিহাস। এক দল প্রবঞ্চনা করেছে আর এক দল প্রবঞ্চিত হয়েছে। এটা ছিলো, আছে, থাকবে।
(এ নিয়ে হাপিত্যেশ করে লাভ নাই, এ কর্ম চলতে থাকবে যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে। হায়না সব সময়ই অন্যের উপার্জিত খাবার খেয়েই জীবনযাপন করে)
মানব ইতিহাস আবার তিন রকম, প্রথম শাসকদের ইতিহাস, দ্বিতীয় সাহিত্যে ইতিহাস আর তৃতীয় গণমানুষের ইতিহাস। এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে সরকারী কর্মচারি ও রাজনৈতিক নেতাদের ইতিহাস।
আমরা জানি নেতা ও সরকারী কর্মকর্তাদের দেশে ও বি-দেশে রয়েছে অপরিসীম কলো সম্পদ। আবার অনেকে আছেন সে টাকার একটা অংশ দিয়ে রাজনীতি কিনে মাঠের নিয়মিত রাজনীতিকদের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেশে ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরাই এখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছে, সাংসদ হচ্ছে। এর ফলে রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ এবং সততার শুন্যতা তৈরী হয়েছে।
যারা সে সম্পদের বড় একটা অংশ দেশে রেখেছে তারা সাধারণত সরকারের ঘনিষ্ঠ, তাদের প্রশ্ন করার মত কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠাণ দেশে নেই। এরা সংসদ ও প্রশাসন চালায়, এক কথায় এরাই এখন দেশের মালিক! আর একদল আছে যাদের সেলটার খুব একটা শক্তিশালী না, তবে অবৈধ আয়ের পথ ঠিকই পেয়ে গিয়েছে তারা দেশকে নিরাপদ মনে করে না, তাই দেশের বাইরেই তাদের কালো টাকার একটা বড় অংশের ঠিকানা হয়ে যায়।
বেনজির, মতিউর, আসাদুজ্জামান ও আবেদ আলী এরকম আরও অনেকে সরকারি চাকরিতে থেকেই বিলিয়ন টাকার মালিক হয়ে গেলো কীভাবে? সরকার তাদের খবর জানত না? না জানলে প্রশ্ন কেন জানলো না? তাদের হাতে এইসব জানার মত মেকানিজমতো আছে, তবে তাদের কেন ব্যাবহার করা হলো না? নাকি সরকার সব জেনেও তাদের এই সব অপকর্ম করতে স্পেস ছেড়ে দিয়েছে?
এ ছাড়া সরকারী কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ধারা ১৩(১) এ ‘সম্পত্তির ঘোষণা’ নামক ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে প্রত্যেক সরকারী কর্মচারীকে চাকরিতে জয়েন্ট করার আগে তার পরিবারের সব সদস্যর সম্পদের হিসাব দাখিল করতে হবে, এর পরে প্রতি ৫ম বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তার নিয়ন্ত্রীত পরিবারের সব সম্পত্তির হিসাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে। এ বিধি বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে? হলেতো সরকারের কাছে সকল কর্মচারীর হিসাব থাকার কথা।
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসতে পারে কেউ যদি সত্যি হিসাব না দাখিল করে থাকে তবে সরকারের কী করার আছে? (এ রকম প্রশ্ন করার যদিও কোন কারণ নাই কারণ আমরা জানি সরকার চাইলে সব রকম গোপন কর্মের তথ্য উম্মচন করতে পারে। তবে সেটা মন থেকে সততার সাথে চাইতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো এমন সরকার কী বাংলাদেশে কখনো ছিলো?) এর সহজ উত্তর সরকারের কাছে NBR আছ, দুদক আছে, তাদের কাজইতো এই সব অসংগতি বের করা। তারা যদি তা না করে সকাল-সন্ধ্যা অফিস করেই অনেক কাজ করেছে বলে মনে করে তবেতো তারা এই কাজের যোগ্যতাই রাখে না। আর যদি ইচ্ছা করেই অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে থাকে তবেতো তারাও অপরাধী, এই অপরাধে তাদেরও শাস্তি হওয়ার কথা। তা কী কখনও হয়েছে? হয়নি তাইতো এখন দেশে দূর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে পরেছে। উলটা আমরা দেখেছি একজন দুদকের পরিচালক এই রকম অপরাধীদের খোঁজ করতে গিয়ে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনির পরিবারের বড় রকম অপকর্ম ধরে ফেলেছিলেন, যার পুরস্কার হিসাবে তার চাকরি চলে গেল। এর পরে দেখা গেল তিনি ভাইয়ের মুদিদোকানের ম্যানেজারের কাজ করে সংসার চালায়।
এই যদি হয় সততার পুরস্কার তবে এই দেশের মানুষ সততার পথে যাবে কোন রিস্কে? এরই ফলে আমরা এখন আবেদ ড্রাইভার, বেনজির, মতিউর আর ছাগল ইমরান, ছালাম মুর্শেদী এবং পিরোজপুর-২ এর সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজের মতো (খোজ করলে দেখা যাবে প্রতি সংসদ সদস্যই একএকটা অপরাধের খনি চালায়) হায়নাদের টাকার অন্ধকারে আটকে আছি। এর দায় কী সরকার এড়াতে পারে?
যেহেতু দেশে সুশাসন খুব একটা নাই সেহেতু যাদের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা আছে তাদের সিন্দুক কালো টাকায় পুর্ণ হবে সেতো এই দেশে স্বাভাবিক, কিন্তু একজন সামান্য ড্রাইভার এতো টাকার মালিক হয়ে যদি কর্তাদের সমান হয়ে যায় তবে তাদেরতো লজ্জা হওয়ার কথা! কর্তারা এটা হতে দিলো কেন! এটা কী ঠিক হয়েছে!
এক ড্রাইভার কালো টাকায় খাজাবাবর মাঝার প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের সেবায় নিয়োজিত হয়েছিলেন, তার কথাতো আমরা অনেক দিন আগেই ভুলে গিয়েছি। তাইতো আবেদ আলি সেই ড্রাইভারী করে বিপুল পরিমান কালো টাকা দিয়ে সেই ধর্ম সেবা করেছে! বেনজির ও মতিও নাকি ধর্মকে প্রচুর দান করেছেন! সব চোর এই ভাবে ধর্মের ঠিকাদারিতে নামে কেন? এর মানে কী? চোরেরা বেশি ধর্ম পালন করে নাকি ধর্মই চোরদের পালন করছে? ধর্মগুরুদের বিষয়টা ভেবে দেখা দরকার, তারা দুর্বৃত্তের হাতে ধর্ম ছেড়ে দিবে নাকি তাদের থেকে রক্ষা করবে?
বাংলাদেশে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার নাগালের অনেক বাইরে। এর জন্য কী এই অবৈধ টাকার কোন দায় নাই? আছে, সব ক্ষেত্রের অবৈধ আয়ের টাকার মালিকরা বাজারে গিয়ে ৫টাকার পণ্য প্রশ্ন ছাড়াই ৮-১০টাকা দিয়ে নিয়ে নিচ্ছে, কারণ তাদের এতে খুব একটা কষ্ট হয় না। তারা ২০টাকার রিক্সা ভাড়া ৩০টাকা থেকে ৩৫ টাকা অনায়াসেই দিয়ে দিচ্ছে। এতে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের সমস্যা হয়, তারা যখন সেই পণ্য বা সেবা গ্রহণ করতে যায় তখন তার কাছেও বাড়তি টাকাটা দাবি করা হয়। এভাবে সাধারণ মানুষ এই কালো টাকার চাপে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে অথচ এসব যাদের দেখার কথা তারা তা দেখছে না। যদি দূর্নীতি আটকে দেয়া যেত তবে বাজারটাও কিছুটা নিয়ন্ত্রনে চলে আসত।
এক অপরাধের আড়ালে আর এক অপরাধ ধামাচাপা পরে যাওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে আছে, সেই পথে বেনজির, মতিউররা ঢেকে যাবে নাতো? তারা আবার সরকারের আশীর্বাদের উপর ভর করে সমাজে ফিরে তাদের কালোটাকার দখল পেয়ে যাবেনাতো? যদি তাই হয় তবে সেটা হবে এই দেশের জন্য দুর্ভাগ্য।
দূর্নীতির অভিযোগ বরাবর বাতিল করে দিয়েছে সরকার বাহাদুর, কাজটা কী তারা ঠিক করছে? এতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা এক রকম বৈধতা পেয়ে যায়, এর ফল দেশের জন্য কখনও ভালো হয় না। সরকারের উচিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা। এর ফলে সমাজে যে বার্তা যাবে তাতে দুর্নীতিবাজরা সামাজিক ভাবে দূর্বল হয়ে যাবে, এর ফলে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষজন তাদের চিহ্নিত করতে এগিয়ে আসার সাহস পাবে। এই ক্ষেত্রে সমাজের সুধীজনের মূল্যায়নের সমালচনা না করে সরকারের উচিত তাদের সহায়তা গ্রহণ করা, এতে সরকার ও দেশ উপকৃত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ এখন আমাদের কাছে তরকারির মত হয়ে গিয়েছে, যাই খাইনা কেন একটা তকারি লাগেই। তেমনই যাই লিখি না কেন মুক্তিযুদ্ধ সামনে আসবেই। আমাদের যোদ্ধারা এবং বঙ্গবন্ধু এই আবেদ, বেনজির, মতি, আসাদুজ্জামান, দিপুমনি বা মহারাজদের দেশটা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য জীবন বাজি ধরেছিলেন? কী উত্তর দিবেন তাদের কাছে যারা সরকার চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন?
এখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ চলছে, আমাদের জীবন এমনিতেই দূর্গতির মধ্যে আছে তার উপর আবার মরার উপর খরার ঘা হয়ে চেপে বসেছে এই নোংড়া চরিত্রের হায়নাগুলো। এরা আর কত দিন থাকবে, বলতে পারো পাঞ্জেরী?
আড়াই হাজার বছর আগে চানক্য ও সক্রেটিস সরকারের যে রূপরেখা দিয়ে গিয়েছেন নিজেদের আধুনিক মনে করা আমরা সেই লেভেলে এখনও যেতে পারিনি, আধুনিক হলাম কীভাবে? ঢাকার পুলিশ কমিশনারের দুর্নীতির কথা উম্মুক্ত করতে গিয়ে আর একজন অফিসার চাকরি থেকে বরখাস্ত হলো, একজন মুদি দোকানি হলো। এসব দেখে জীবনমুখী লেখক ‘হায়দার হোসেনে’র মত চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারি না, সেখানেও বাধা চলে আসে শব্দ দূষণের অভিযোগে!
সম্রাট সাইরাস তার অসৎ প্রধান বিচারপতির চামড়া জিবিত অবস্থায় খুলে নিয়ে বিচারকের চেয়ারের কভার বানিয়ে দিয়ে বিচারকের পদে সেই বিচারকের ছেলেকে নিয়োগ দিয়ে তার বাবার চামড়ায় মোড়ানো চেয়ারে বসতে বাধ্য করেছিলেন। এইভাবে তিনি তার বিচার ব্যাবস্থাকে কলুষ মুক্ত করেছিলেন। আমাদের কোন সরকার কী সেই নজির স্থাপন করতে পারে না? পারে কিনা জানিনা তবে পারলে আড়াই হাজার বা পাঁচ হাজার বছর পরেও তার সততার কথা মানুষ নমে রাখতো।
জননী আপনার সন্তানদের উপর এমন একবার চেষ্টা করে দেখবেন নাকি? আমরা একটু উৎসব করি, প্রাণ ভরে স্বাস গ্রহণ করি। মানুষের জীবন আর কত দিনের, কর্মইতো সব। একটা বেনজির বা একটা মতিরে কোরবানি দিয়ে দেখেন না, আপনাকে দুর্গার আসনে বসিয়ে দেবে বাঙ্গালী।