দার্শনিক সক্রেটিসের অমর উক্তি হইল—নো দাইসেলফ, অর্থাৎ নিজেকে জানো। নিজেকে জানিবার মাধ্যমেই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন সম্ভব। ইহার মাধ্যমে মানুষ হইতে পারে বিনয়ী, সৎ, সাহসী ও স্বল্পভাষী। ইহার মাধ্যমে দম্ভ ও অহংকারকে চূর্ণ করিয়া আস্তে কথা বলা রপ্ত করিতে পারে মানুষ। মানুষের জীবনে সমস্যা থাকিবেই; কিন্তু সমস্যাটা পূর্বে সঠিকভাবে চিহ্নিত করিতে হইবে। আর এই জন্যও আমাদের পূর্বে নিজেদেরকে জানিতে হইবে। এই উপমহাদেশে সাতচল্লিশের দেশভাগের পর কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া লিখিয়াছিলেন, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যেসব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো!/ তার বেলা?’ ইহার পর সৃষ্ট দেশটিও একসময় ভাঙিয়া গেল। জন্ম নিল আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এই দুই দেশ গড়িবার আন্দোলনে যাহারা সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করিয়াছিলেন তাহাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আত্মাহুতি এবং অপমান-অপদস্থের জের শীঘ্র শেষ হইবার কথা নহে। সর্বশেষ দেশটির অভ্যুদয়ে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলি সরাসরি সাহায্য-সহযোগিতা করিল। সংবিধান প্রণয়নেও তাহাদের কথা ভাবিতে হইল। যেই মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিলেন এবং দুই লক্ষ মা-বোন হারাইলেন সম্ভ্রম, সেই দেশটির জন্মের পর সেইখানে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নহে। এই জটিলতা গত ৫০ বৎসরে একটু একটু করিয়া নিরসন করা দরকার ছিল; কিন্তু দিনদিন তাহা যেন আরো বাড়িয়া চলিয়াছে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করিয়াছি। তাহা ছাড়া যেই হেতু আমরা গণতান্ত্রিক বিশ্বে বসবাস করিতেছি এবং আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ঐতিহ্য বহনকারী, তাই আমরা যাহা খুশি তাহাই করিতে পারি না।
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলির সম্পদ সীমিত, অথচ জনসংখ্যা বিপুল। জমির পরিমাণ বা আয়তনও কম। এই জন্য এই সকল স্বাধীন দেশে নানা প্রকার সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিতেছে। এখন বলা হইতেছে স্বায়ত্তশাসিত, সাংবিধানিক ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলিকেও অর্থ খরচের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি লইতে হইবে। জানা-অজানা বা অনুমানভিত্তিক হইলেও নিশ্চয়ই ইহার কারণ রহিয়াছে। এই জন্য এমন দেশে মাথা ঠান্ডা রাখিয়া কাজ করা দুরূহ। এই জন্য কি গ্রীষ্মকাল বা শীতকাল—সকল সময় আমাদের মাথার উপর আইসব্যাগ রাখিতে হইবে! এই সকল দেশে যাহারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তাহারা যেন ভুলিয়া যান যে কখনো না কখনো তাহাদের সরিয়া দাঁড়াইতে হইবে। কেননা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাহারো সিংহাসন চিরস্থায়ী নহে। তাই যখন তাহারা আর ক্ষমতায় থাকিবেন না, তখন যে একই রকম অপকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটিবে না, তাহা নিশ্চয়তা দিয়া বলা যায় না। মানুষ ভাত, মাছ-মাংস হইতে শুরু করিয়া কত কী না খায়; কিন্তু আছাড় খায় কেন, ইহাই একটি বড় প্রশ্ন। প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় হইতে শুরু করিয়া কতকিছুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী; কিন্তু এই সকল দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভোটাধিকার ইত্যাদির গ্রাফ শুধু নিচেই নামিতেছে। এই জন্য যাহারা দেশ শাসনের মতো দুরূহ কাজের দায়িত্ব পালন করিতেছেন, দিন শেষে তাহারা কতটা সফল হইয়াছেন, তাহা লইয়া চিন্তাভাবনা করিতে হইবে। গদি আরামদায়ক বটে; কিন্তু গোদের উপর বিষফোড়া নিঃসন্দেহে অস্বস্তিদায়ক। এই কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নামিয়া আসে। গত পঞ্চাশের দশকে এই উপমহাদেশের এক নেতা গুলিতে নিহত হন। মৃত্যুকালে তিনি বলিয়াছিলেন যে, খোদা যেন তাহার দেশটিকে হেফাজত করেন। তাহার উক্তি অনেকেই তখন সঠিকভাবে উপলদ্ধি করিতে পারেন নাই। উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি একসময় এমনরূপ ধারণ করে যে, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দেশটি রক্ষা করিতে হয়।
২০২২ সাল অতিক্রান্ত হইয়া যাইতেছে; কিন্তু এই সকল গরিব দেশে বৎসরের পর বৎসর সমস্যা কেবল পুঞ্জীভূতই হইতেছে; কিন্তু সমাধানের পথে অধিকাংশ লোকই হাঁটিতেছেন না। বরং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাহারা উলটাপথে চলিতেছেন। এই জন্য কবি লিখিয়াছেন, ‘কোন এক উল্টো রাজা, উল্টো বুঝলি প্রজার দেশে/ চলে সব উল্টো পথে, উল্টো রথে, উল্টো বেশে।’ এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হইবে তাহা অনুমান করাও কঠিন হইয়া পড়িতেছে।