এই লেখা শুরু পর্যন্ত স্পিকার নির্বাচন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ। স্পিকার নির্বাচনে দফায় দফায় ভোটেও আসেনি মীমাংসার চূড়ান্ত ফল। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার হতে একজন প্রার্থীর দরকার ২১৮ ভোট। কিন্তু রিপাবলিকান প্রার্থী কেভিন ম্যাকার্থিসহ কোনো প্রার্থীই এই পরিমাণ ভোট পাননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ার কারণে ডোমোক্রেটিক পার্টি থেকে যেহেতু স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, সেহেতু কোনো জটিলতা ছাড়াই স্পিকার নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি উতরে যাবে—মনে করা হচ্ছিল এরকমটাই। কিন্তু সবকিছু তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে জনা বিশেক কট্টর রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা। কেভিন ম্যাকার্থিকে হাউজ স্পিকার নির্বাচিত করতে তাই চরম বেকায়দায় পড়েছে রিপাবলিকান পার্টি। একই সঙ্গে টিকে থাকার কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন ম্যাকার্থি নিজেও। হাউজ স্পিকারের চেয়ারে বসতে তিনি চেষ্টা চালিয়ে আসছেন অনেক আগে থেকেই। হাউজে রিপাবলিকানদের বিজয়ের ফলে আশার আলো দেখছিলেন তিনি। কিন্তু রক্ষণশীল প্রতিনিধিদের কারণে ঝুলে গেছে তার ভাগ্যের চাবি!
গত নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ যায় রিপাবলিকান পার্টির হাতে। কিন্তু পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কেবল দলীয় বিভক্তির কারণে রিপাবলিকানরা এখন পর্যন্ত স্পিকার নির্বাচিত করতে পারেননি, যা আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা! এমন ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বশেষ ঘটে ১৯২৩ সালে। দুঃখজনকভাবে ১০০ বছরকাল পর ফিরে এসেছে সেই চিত্র! কট্টরপন্থী সদস্যদের বিদ্রোহের মুখে পড়ে ধূলিসাৎ হতে চলেছে কেভিন ম্যাকার্থির স্পিকার হওয়ার স্বপ্ন! সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই বিদ্রোহীরা কোনো মূল্যেই সায় দিচ্ছেন না ম্যাকার্থির পক্ষে! উল্লেখ করার মতো বিষয়, বেশ কিছু বিষয়ে ছাড় দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন ম্যাকার্থি, যেগুলো নিয়ে শুরুর দিকে অনড়, কঠিন ছিলেন। এভাবে ছাড় দেওয়ার ফলে স্পিকারশিপের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বেশ খর্ব হবে জেনেও বিকল্প না থাকায় ছাড়ে রাজি হয়েছেন ম্যাকার্থি! কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! গোঁ ধরে বসে আছেন নির্বাচন-অস্বীকারকারী ট্রাম্পের (বাইডেনের কাছে পরাজয়কে মানতে চান না ট্রাম্প) অনুগত এসব প্রতিনিধি।
মজার ব্যাপার হলো, স্পিকার নির্বাচনে এই অচলাবস্থা নিরসনে তেমন একটা কাজ করছে না ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ! তার কট্টর ভক্ত-সমর্থকরাই শুনছেন না তার কথা! বহু পর্যবেক্ষকের কাছে বিষয়টি যারপরনাই আশ্চর্যজনক! রিপাবলিকানদের এহেন অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাম্পের আহ্বান পাত্তা না পাওয়া স্বাভাবিকভাবেই অবাক হওয়ার মতো। প্রথম দফায় নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার ঠিক এক দিন পর তথা বুধবার নিজ দল ও বেঁকে বসা রিপাবলিকানদের সতর্ক করে দিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘একটি বিশাল বিজয়কে বিব্রতকর পরাজয়ে পরিণত করবেন না…কেভিন ম্যাকার্থি উপযুক্ত প্রার্থী…তিনি ভালো কাজ করবেন, দুর্দান্ত কাজ করবেন…তাকে নির্বাচিত করে দেখুন আমার কথা কতটা সত্য!’ এই বাক্যগুলোতেই থেমে থাকেননি সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। আরও জোরালো ও খোলাখুলিভাবে বলেন, ‘কেভিনকে ভোট দিন, দর কষাকষি বন্ধ করুন, বিজয়ের মুকুট মাথায় পরুন…’।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ট্রাম্পের কোনো আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছেন না ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া রিপাবলিকান প্রতিনিধিরা। ম্যাকার্থির পক্ষে সাফাই গাওয়া ট্রাম্পের কথাকে তারা একেবারেই গায়ে মাখছেন না। যেমন, ট্রাম্পের উক্ত আহ্বানের পরপরই ম্যাকার্থির বিরুদ্ধাচরণ করা রিপাবলিকান ম্যাট গেটজ নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন। গেটজ এমন সব মন্তব্য করেন, যাতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ট্রাম্পের কথাকে তিনি একেবারেই আমলে নেননি। ট্রাম্পের কথার জবাবে গেটজ মন্তব্য করেন, ‘ম্যাকার্থিকে নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্টের অতি উচ্ছ্বাস নিতান্তই দুঃখজনক! তবে যত কথাই বলা হোক না কেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়। কোনো, কারো আহ্বানেই আমি আমার ভোটের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব না।’
ম্যাকার্থিকে সমর্থনের ব্যাপারে ট্রাম্পের আহ্বানের সুরেই কথা বলেন হাউজের সাবেক স্পিকার নিউট গিংরিচ। অত্যন্ত প্রতাপশালী এই রিপাবলিকান নেতা ম্যাকার্থিকে নির্বাচিত করার ব্যাপারে দলের সদস্যদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। ম্যাকার্থির বিপক্ষে মাঠে নামা রিপাবলিকান প্রতিনিধিবৃন্দসহ দলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সব ভুলে গিয়ে ম্যাকার্থিকে নির্বাচিত করতে কাজ করুন। তা না হলে বিশৃঙ্খলা কেবল বাড়বেই।’ গিংরিচের এই ‘অদ্ভুত’ মন্তব্যের পর মনে হয়েছিল, নিভু নিভু বাতি হয়তো জ্বলে উঠবে! কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি তা। বিদ্রোহ করে বসা রিপাবলিকানরা ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান ম্যাকার্থির রক্ষণশীলতার বিষয়ে এতটাই সন্দিহান যে, কোনোভাবেই তারা ম্যাকার্থির সঙ্গে বসতে চান না! বিদ্রোহী রিপাবলিকানদের একজন সাউথ ক্যারোলিনার রাল্ফ নরম্যান তো গণমাধ্যমের সামনে ঘোষণাই দিয়ে বসেন, ‘আমি ম্যাকার্থিকে এক বিন্দু পরিমাণও বিশ্বাস করি না। কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করব না।’ বলা বাহুল্য, দফায় দফায় ভোটের পর জটিলতা ক্রমশ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত হারের পর প্র্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াতে ম্যাকার্থির ওপর চাপ বাড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার বিকল্প হিসেবে ইতিমধ্যে কয়েক জন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানকে প্রার্থী করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে ভেতরে-বাইরে। লক্ষ্য একটাই—অচলাবস্থার অবসান।
মোটাদাগে উল্লেখ করার মতো বিষয়, ট্রাম্প এবং গিংরিচের মতো শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের আহ্বান সত্ত্বেও বিভেদের পারদ নামছে না এতটুকু! সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বিখ্যাত বিধায়কের কাছ থেকে আসা আহ্বানও কাজ করছে না! এসব বিষয় এটা স্পষ্ট করে, রিপাবলিকানদের মধ্যে বিভক্তির শিকড় বেশ গভীরে! একথা বললে অত্যুক্তি হবে না, রিপাবলিকান দল এখন দুই ভাগে বিভক্ত—ট্রাম্প সমর্থক ও ট্রাম্প বিরোধী। এমন একটা অবস্থায় আসন্ন ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে স্বভাবতই শঙ্কা বাড়ছে রিপাবলিকান শিবিরে। দলের বাইরে ও ভেতরে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা যে মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে, পাচ্ছে, তাতে করে ২৪-এর প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে রিপাবলিকান দল থেকে ট্রাম্প চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলে কী ঘটতে পারে, তা ভাবাচ্ছে রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কংগ্রেসের ২০ বা তার বেশি সদস্যের মধ্যে যারা ম্যাকার্থিকে সমর্থনের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন, তারা নিজেদের অবস্থান থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। ম্যাকার্থির বড় বড় ছাড় সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পথে হাঁটেননি তারা। এসবে তারা ন্যূনতম আপ্লুত বলেও মনে হচ্ছে না। সাউথ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান প্রতিনিধি রাল্ফ নরম্যানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা আসলে কী চান? এর কোনো খোলসা জবাব আসেনি তার কাছ থেকে। নরম্যানের মতোই অবস্থা বিদ্রোহ করা প্রত্যেক রিপাবলিকান প্রতিনিধির।
নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে ক্যাপিটাল হিলে যে ঘটনার জন্ম দেয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী, তা কী ধরনের অভিঘাত বয়ে আনতে পারে মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গনে—হাউজে চলমান অচলাবস্থা তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আগ্রাসি কর্মকাণ্ড যে কত বড় নাটকীয়তার জন্ম দিতে পারে, নিশ্চিত বিজয়কে চ্যালেঞ্জের মুখে উপনীত হওয়ার মধ্য দিয়ে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রিপাবলিকানরা। এই ঘটনা হয়তো ট্রাম্পকেও দিয়ে যাচ্ছে ‘বাস্তবতার শিক্ষা’। এমনকি মার্কিন গণতান্ত্রিক ধারা যেভাবে বিভাজন ও পক্ষপাতিত্বের কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ছে, তা গোটা বিশ্বের জন্যও অশনিসংকেত!
হাউজের ভাগ্যে যা কিছুই ঘটুক না কেন, দলে ট্রাম্পের অবস্থান ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে—এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অবশ্যই তার হাতে এখনো অনেক সময় আছে সবকিছু ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে পথ কি খুব সহজ হবে তার জন্য? ট্রাম্প ক্ষমতার গদি থেকে নামার পর একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে, তাতে তার সামনে ‘কঠিন’ রাস্তা বলেই ধরে নেওয়া যায়। এ কথা হয়তো ট্রাম্প নিজেও জানেন। হয়তো বেশ ভালোমতোই জানেন! আর এ কারণেই আমেরিকার রাজনীতির খোলনলচে পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। আমরা এখন হাউজ স্পিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘বিতর্কিত ভোট’ দেখতে পাচ্ছি। রিপাবলিকান দলের মধ্যে ‘উগ্রবাদী মনোভাবসম্পন্ন’ একটা গোষ্ঠীও তৈরি হতে দেখা গেছে! এসব কীসের লক্ষণ, কেনই-বা এমন সব ঘটনা ঘটছে আমেরিকার মাটিতে—এসব আন্দাজ করা বেশ মুশকিল!
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রভাব কমে যাওয়া তার পরাজয়ের ক্ষেত্রে বড় কারণ হলে তা হবে স্বাভাবিক বিষয়। ক্যাপিটাল হিলের ঘটনার সূত্র ধরে দিনকে দিন তিনি নিজেকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন, যার জন্য তাকে চরমভাবে ভুগতে হবে সামনের দিনগুলোতে। ফ্লোরিডার গভর্নর রন দি-স্যান্তিস হোক কিংবা জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি—কাউকেই মোকাবিলা করা সহজ হবে না ট্রাম্পের জন্য। এসব রাজনীতিবিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার চিন্তা করে মাঠে নামলে গো-হারা হারতে হবে দিনশেষে! এবং আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে যদি হাউজের ঘটনার মতো অচলাবস্থা চলতেই থাকে, তবে পরবর্তী রাজনৈতিক যুগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভোটাররা অন্য কাউকে বেছে নেবেন। কে বলবে সেটাই অনিবার্য কি না?