কবি সাবিত সারওয়ার-এর প্রেস কনফারেন্স: উনুচ্চারিত সত্যের সমকালীন সূর্যোদয়
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত কবি সাবিত সারওয়ার-এর প্রতিবাদী ছড়াকাব্য প্রেস কনফারেন্স। বইটি সাজিয়ে তোলা হয়েছে ৪০টি ছড়াকাব্যে। সমকালীন বাস্তবতায় রচিত নানা অনুসঙ্গের বর্ণনায় পাঠক উপভোগ করবেন সাহিত্য রসের শিল্পীত স্বাদ। সাধারণ থেকে বোদ্ধা-জন সামান্য বুদ্ধি খরচে পাবেন চিন্তার চতুর্মুখী খোরাক। অনুভবে ধরা দেবে শাশ্বত-সত্যের অনিবার্য আহ্বান।
প্রায় প্রতিটি লেখায় বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চারণে হাজির করা হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাপ্রবাহ। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছে কবির কলম। ছন্দবদ্ধ কাব্যিক বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে চলমান সময়ের নানা সংকট। সমকালীন চিত্র বিকশিত হয়েছে সরল বর্ণনায়। বহুমত-পথের গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য বিনির্মাণের অন্তরায় শনাক্তের চেষ্টা করেছেন কবি। মুক্তচিন্তার প্রসারে প্রবর্তিত ব্যবস্থার নানান ফাঁক-ফোকরের সমালোচনা করা হয়েছে নির্মোহভাবে। সর্বগ্রাসী তৈলচিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে সামগ্রিক অবয়বে। বাজার সিন্ডিকেটের মতো গড়ে ওঠা গণমাধ্যম ও করপোরেট কালচারে ছড়িয়ে পড়া চর্চিত তোষামোদকে উল্লেখ করা হয়েছে চমৎকারভাবে। শনাক্ত করা হয়েছে অনৈতিকতা, অসাধুতা এবং অসার বৃত্তের দাপট। গণ্ডিবদ্ধ ভাবনা উপেক্ষায় উজ্জীবিত করা হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক মননকে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে বিশ্বমন্দায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও। নানান অস্থিরতায় যেমন বেড়েছে তথ্যগুজবের ভয়াবহতা, তেমনি কম নয়- তথ্যবিলোপ বা বিলাপের করুণ কারসাজিও। উনুচ্চারিত সেই সত্যের সমকালীন সূর্যোদয় কবি সাবিত সারওয়ার-এর ‘প্রেস কনফারেন্স’।
১.
তিনি বললেন, সহজ কথা
জোরছে হলো হাততালিও
আমি ভাবি- হায় গরুরা
এটাও বুঝি কাকতালীয়!
……………..
নোংরামি ও হিংসে কথায়
ঐতিহাসিক তত্ত্ব দিলে
ঢেঁকুর তোলো আহ কী দারুণ
কাঁঠালের আমসত্ত্ব গিলে!
……………..
‘সাংঘাতিক’-এর তকমা নিয়ে
দেশ ও জাতির শরবতে
তোষামোদের তোকমা ঢালো
নানান অপকর্মতে! (-প্রেস কনফারেন্স)
প্রতিটি অপকর্মের কার্যকারণ আছে। রয়েছে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাষ খাওয়ার মতো অনৈতিক প্রবণতাও। মুখে মধু- অন্তরে বিষ। তোষামোদের প্রলেপ দিয়ে ঢাকা পড়ে বাহ্যিক রূপ। বোতাম আঁটা জামার নিচে খেলা করে উল্টো চিত্রের সিন্ডিকেট। মাঠেই মরে মেধাবীদের মূল্যায়ন। দোষারোপের রোষানলে জ্বলে সরলতা। দগ্ধ-দাহ্যের সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে ‘সিন্ডিকেট’ শিরোনামের ছড়াকাব্যে।
২.
বাহ কি ভালো- খুব মজাদার, চলছে তো বেশ সিন্ডিকেটে
মারছে কেবল মধ্যে ফেলে গো-বেচারার পিন্ডি কেটে।
মেধাবীরা মর্ত্যে মরে কথায় পটুর বাজার চড়া
ভেতর-বাহির খুব সাবলীল অসুস্থতার নড়াচড়া। (-সিন্ডিকেট)
সিন্ডিকেট বলয়ের বাইরে নয় রাজনীতি। নানা ছল-চাতুরিতে সৌভাগ্যের সিঁড়ি পেতে মরিয়া অযোগ্যদের হাত-পা। সমান তালে তারা চষে বেড়ায় অর্থ-কড়ি ও বিত্ত- বৈভবের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে। ক্ষেত্র বিশেষ পেয়ে যায় রাজনৈতিক সুবিধাও। শূন্য জ্ঞানে তৈরি হয় অন্তঃসারহীন পাণ্ডিত্যের চাষবাস। দিন দিন বাড়ে হাইব্রিড গণ্ডির পরিসর। ঠিক যেমনটি কবি বলেছেন।
৩.
বিত্ত- বৈভবে মোচওয়ালা মচুয়া
ছুটে চলে দর্পে ধানখেত- কচুয়া
নয়-ছয় লেন ধরে ছোট-বড়ো গল্লি
পেরুলেই চোখে পড়ে ঈশ্বরপল্লি।
……….
কিছুদিন পেরুলেই মচু হয় মন্ত্রী
জটাচুলো জাদুকর- তাঁতি হয় তন্ত্রী
মেডিকেলে মার খাওয়া আঁখিদের আক্তার
জেল থেকে ফিরে হয় নামকরা ডাক্তার।
……….
ইন্টারে তিনবার ফেল করা ছাত্র
হয়ে যায় শিক্ষক- ‘শ্রদ্ধার পাত্র’
জুতো ছেড়ে জগু দা পাঠ করে চণ্ডী
এভাবেই বেড়ে যায়- হাইব্রিড গণ্ডি। (- হাইব্রিড)
তোষামোদের বেশ গুরুত্ব আছে। তৈল মর্দনের এই তেজারতি অফিস-আদালত কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খুব সহজেই খুশি করার এই শৈল শৌখিনতার শিল্পরূপ পেয়েছে। দূরমূল্যের বাজারে সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি তোমার-আমার দাম। সেই বাস্তব বয়ান কবির উচিৎ কথায়। কবি লিখেছেন-।
৪.
দাম বেড়েছে পরকীয়ার
দাম বেড়েছে পরের
দাম বাড়েনি তোমার- আমার
বউয়ের কাছে বরের।
……………..
দাম বেড়েছে তোষামোদের
উচিৎ কথায় মারা!
সস্তাতে খুব মিলছে এখন
তেল মালিশের ধারা। ( -উচিৎ কথা)
সাম্প্রতিক সময়ে তেলের তেলেসমাতি কম দেখেনি দেশ। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দরে নানান রেসিপিও শিখতে হয়েছে গিন্নিদের। সেই তিক্ততা ভোলার কালেই জাতির সামনে হাজির জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের অস্বাভাবিক দর। সেই ছোঁয়া আবারও লাগে রন্ধন শিল্পে।
স্যাটায়ার ভঙ্গিতে কবির চমৎকার বর্ণনায় উঠে এসেছে সব। বেশ চটকদারও বটে। উলুবনে শিরোনামে চমৎকার এক রান্নার গল্প বলেছেন কবি। কল্পিত রেসিপির এক্সপেরিমেন্ট পৌঁছে গেছে অনন্য উচ্চতায়। ফলে গিন্নির ঘরে এখন জলেই জ্বলছে চুলো! কিংবা মরিচবাটায় হচ্ছে মজার দুধভুনা! কল্পিত আয়োজনে শিল্পীত রান্নাবান্না শেষে কবি অতিথি হিসেবে হাজির করেন রাষ্ট্রীয় এক অতিথিকে। অলিক আপ্যায়নে তিনিও তোলেন তৃপ্তির ঢেকুর। এসব দেখে, বউ ক্ষেপে খুব খুন! কারণ- তার কাছে মনে হয়েছে- রন্ধন শিল্পের চমৎকার এই উদাহরণ কেবল উলুবনে মুক্ত ছড়ানোরই নামান্তর! এমন হাস্যরসের তীর্যক উক্তিতে কবি চেষ্টা করেছেন সমকালীন চিত্র আঁকতে। পুরো বিষয়টি এভাবেই ধরা পড়ে কবির কলমে-
৫.
এই তো সেদিন দুধ করেছি ভুনা
মসলা কেবল মরিচবাটা অল্প
মন্ত্রী মশাই দুচারটি ঢোক গিলে
রাত পুরোটাই চুটিয়ে দিলেন গল্প!
……………..
ভাবছি আরো- রান্না যখন শিল্প
দোষ কি আহা এক্সপেরিমেন্ট হলে
কিন্তু আমার বউ রেগে খুন- ইশ্
উলুবনে মুক্ত ছড়াই বলে! (-উলুবনে মুক্ত)
কবির কাজ সত্যকে উন্মোচন। নতুন পথ ও পথের সন্ধানে স্বপ্ন দেখানো। জাতিকে জাগিয়ে তোলা। জাতীয় স্বার্থে কবির উচ্চারণে গর্জে ওঠে কলম। কবিতা হয় প্রতিবাদের সূতিকাগার। কারণ সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ কমলে সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা। জাতীয় জীবনে ক্রমাগত নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বেড়ে যায় দেশপ্রেমিকের ছদ্মবেশে মীরজাফরের প্রেতাত্মাদের উৎপাত। সামাজিক নানা অসঙ্গতি রূপ নেয় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে। এ সময় প্রয়োজন একদল সাহসী তরুণ। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। লোভ-ক্ষোভের অন্যায্য আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে বুকটান করে দাঁড়ানো দরকার প্রতিবাদের প্লাকার্ড হাতে। সার্বভৌম সীমানায় হয়ে উঠতে হয় নির্ভিক প্রহরী। তবেই মেলে সংকটের সমাধান। আগামীর ভোরে হয় সোনালি স্বপ্নের সূর্যোদয়। সেই আহ্বান কবির প্রতিবাদ শিরোনামের ছড়াকাব্যে।
৬.
আবার যদি গ্রামে গড়ে তোলো দুর্গ
পাড়ায় পাড়ায় শ্লোগান তোলো রুখো
অত্যাচারী পালাতে পাবে না পথ
নির্ভীক জাগো চিতিয়ে তোমার বুকও।
……………..
খনিজাত গ্যাস- কয়লা- পাথর চেটে
ভূমি ইজারার ব্যবসাপাতিতে চোখ
বন্দর-বয়া বিকানো ফন্দি এঁটে
সীমানায় কারা- ঢুকে যায় কার লোক! (-প্রতিবাদ)
সত্য বর্ণনায় কবির কার্পণ্য নেই। আর মিথ্যের মসনদে সত্য উচ্চারণের ভয় চিরকালের। প্রতিটি মস্তিষ্কে ভর করে পিছুটানের চিন্তা। জবানে ঝুলে যায় অদৃশ্য তালা। সমাজ-সংসারে প্রবাহিত হাওয়া বলে দেয় শঙ্কিত সময় বহমান। এমন অবস্থায় চারদিকে চলমান আত্ম-বিক্রির কাল। এমন অবস্থায় একজন কবির কাজ কি? ধ্যানমগ্নতা নাকি প্রতিবাদ? বিবেক উৎসারিত এই জিজ্ঞাসায় কবিকে লিখতে হয়। লিখে যেতে হয় নির্মোহভাবে। প্রয়োজনে কবিতে হতে হয় কৌশলী। আশ্রয় নিতে হয় রূপকের। ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে চলে কবির কলম। প্রেয়সীর অনুনয় অনুধাবন করেই উচ্চারিত হয় শব্দের সাহসী সংগীত। রচিত হয় ‘লাগামহীন’। কবি লিখেছেন।
৭.
বউ বলেছে, কবিতা বাদ- ছন্দ রাখো চেপে।
উপায় কী হে কাব্যসোনা রাষ্ট্র গেলে ক্ষেপে?
……………..
কাব্যভাষা বদলে ফেলো ‘খবরপতি’র মতো
লাল ও সবুজ ধর্ষিত হোক, হোক ক্ষত-বিক্ষত!
……………..
স্তুতিতে ছন্দ মেলাও রাতকে বলো দিন
মহৎ পুরুষ চাই না আমি- সাহস লাগামহীন! (- লাগামহীন)
……………………….
প্রতিটি রাতের অনিবার্য পরিণতি নতুন সকাল। রাত দীর্ঘ হলেই সকাল সন্নিকটে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা সকাল বিনির্মাণের অগ্রনায়ক। আবারও ফিরবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সোনালি অধ্যায়। শ্রেণিবর্ণ ভুলে মননে জাগবে জাতীয় ঐক্য। ভুলে যাবে ভেদাভেদ-বিদ্বেষ। বৃদ্ধদের গল্পের আসরে নামবে সম্প্রীতির ধারা। মুখে মুখে রচিত হবে প্রাগৈতিহাসিক নানা রূপকথার লৌকিত গল্প। মানবিক মর্যাদায় বেড়ে উঠবে লাল-সবুজের প্রতিটি প্রাণ। শিশুরা হবে যিশুর মতো। নদীর মতো হবে নারী। কবির বিশ্বাস- সেই দিন দূরে নয়।
৮.
এই দেশে একদিন ভোর হবে বটে
সূর্যটা আলো দেবে হেসে অকপটে।
আঁধারের আস্তিনে হেসে উঠে চাঁদ
দূর করে দেবে সব ঝগড়া-বিবাদ।
পানমুখে বৃদ্ধরা গালভরা হেসে
ভুলে যাবে তিক্ততা গৌরবে ভেসে।
শিশুরা যিশুর মতো- নারী হবে নদী
সেই দিন দূরে নয় তুমি চাও যদি। (-ভোর হবে)
‘প্রেস কনফারেন্স’ প্রকাশ করেছে সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থা। বইমেলায় স্টল নম্বর-৩৫৬। এছাড়াও বইটি পাওয়া যাবে অনলাইনে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে বিশেষ ছাড়মূল্যে অর্ডার করতে ভিজিট করুন- রকমারি ডট কম। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বহুমাত্রিক লেখক তুষার আবদুল্লাহকে।