মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের জাপান সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্র, এর পরে তিনি যুক্তরাজ্যে রাজ অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে দেশে ফিরবেন। প্রায় টানা ১৫ দিনের বিদেশ সফর খুবই গুরুত্ব বহন করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। তবে আমি জাপান সফরের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতেই কলম ধরেছি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার এটি ষষ্ঠ সফর। প্রতিটি সফরেই বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কে গতি সঞ্চার করেছে। নানাবিধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাধীনতার এক বছর পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকেই জাপানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বহমান রয়েছে। শেখ হাসিনার এবারের সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৭৩ সালে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সরকারের আমন্ত্রণে দেশটিতে প্রথম সফর করেছিলেন। সেই সফরেই জাপান-বাংলাদেশ আর্থিক সহযোগিতায় দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। সে সময় যমুনা সার কারখানা, কর্ণফুলী সার কারখানা, যমুনা সেতুসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পে জাপানি অর্থায়নে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়। আমি সে সময় কলেজ শিক্ষার্থী ছিলাম। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে মাঠে সক্রিয় ছিলাম। বিদেশি গণমাধ্যম ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর সেই সফরের বর্ণনা শুনেছি এবং দেখেছি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। জাপানে গার্ড অব অনার লাল গালিচা বিছিয়ে এক অভাবনীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয় রাজধানী টোকিওতে। বঙ্গবন্ধুর সেই সফরের সময় বঙ্গবন্ধু ও তার সফরসঙ্গীরা টোকিও ও কিওতোর রাজপথে পরিভ্রমণে যান। জাপানের আবালবৃদ্ধবনিতা ব্যস্ততার মধ্যেও রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাকে একপলক দেখার জন্য ভিড় করেছিল। হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছিল। ২৩ অক্টোবর ১৯৭৩, টোকিওতে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা ও তার স্ত্রী প্রদত্ত সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ব্যানকুয়েট হলে। ব্যানকুয়েট ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের পটভূমি তুলে ধরেছিলেন। সেই সংবর্ধনা সভায় জাপানের তত্কালীন জাতীয়তাবাদী নেতা দেশটির প্রধানমন্ত্রী কাকুয়েই তানাকা তার উদ্বোধনী ভাষণে এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ও তেনশিন ওকাকুরার বন্ধুত্বের মাধ্যমেই জাপানি-বাঙালির বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল। কী আশ্চর্য, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেই সম্পর্কের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন সফরের মধ্য দিয়ে। সুতরাং বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাপানি-বাঙালি মৈত্রীর ধারাবাহিক সম্পর্কের উত্তরসূরি, ঠিক একই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি জাতি রাষ্ট্রের সম্পর্ককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। শেখ হাসিনা এখন সাহায্যনির্ভরতা থেকে কৌশলগত অংশীদারিত্বে মনোযোগী হয়েছেন। কেননা বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। যার কৃতিত্ব কেবলই শেখ হাসিনার। শেখ হাসিনা টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বলতর।
শেখ হাসিনার এবারের জাপান সফর অনেকটাই বর্ণাঢ্যময়। অতীতের যে কোনো সফরের চাইতে এই সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জাপান একটি শান্তিপ্রিয় উন্নত প্রযুক্তির দেশ। দেশটির মানুষও কর্মবীরের মর্যাদায় সিক্ত। জানা গেছে, এ সফরে আটটি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি, শুল্ক, আইসিটি, গণপরিবহন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। গণপরিবহনে মেট্রোরেল বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে দুটি দেশ ঐকমত্য হয়েছে। যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়েছে বর্তমান বাস্তবায়তায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তি যত উন্নত হবে দেশ তত অগ্রসর হবে। প্রযুক্তির ব্যাপকতায় নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। আমরা দেখছি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষসাধনের ভেতর দিয়ে কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য ছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় দক্ষতা অর্জন সম্ভব হবে। বাংলাদেশ জাহাজশিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। গণপরিবহনে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। এসব সেক্টরে জাপানি সহযোগিতা নিশ্চিত হলে উভয় দেশই বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে। আশার বিষয় হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো সরকারিভাবে আমাদের দেশে জাপানের বিনিয়োগের পরিবেশকে আরো সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগও উত্সাহিত হবে। প্রধানমন্ত্রী এবারের সফরে জাপানের উদ্যোক্তা শিল্পপতি তথা বিনিয়োগকারীদের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেছেন। যে বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের ব্যাবসায়িক এবং বাণিজ্যিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রসারে যদি রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকে তবে সেখানে কখনো বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় না। প্রধানমন্ত্রী সে দিক থেকে যথেষ্ট কমিটেড। যে কারণে জাপানিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে অধিক উত্সাহী হয়ে উঠেছে। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে গত ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধীনে ৪০টি কোম্পানি প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই ৪০টি কোম্পানির মধ্যে ৩০টিই জাপানি, বাকি ১০টি অন্যান্য দেশের। এই অর্থনৈতেক অঞ্চলটি পুরোপুরি চালু হলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ আসবে; যেখানে প্রায় ১ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। প্রধানমন্ত্রী সফরকে কেন্দ্র করে আশা করা হচ্ছে খুব শিগিগর বাংলাদেশে আরো ১০০টি জাপানি কোম্পানি ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশে আসছে যাতে আরো ১ লাখেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। তাই সফরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বর্তমানে বিশ্বে চলছে অর্থনীতির কূটনীতি। অর্থনীতির কূটনীতিনির্ভর রাজনীতিই মানুষের কল্যাণময় জগত সৃষ্টি করতে পারে। শেখ হাসিনা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই উন্নয়নের গণতন্ত্রকে বিকশিত করছেন। যুগ বদলে গেছে, বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির দিন শেষ। উল্লেখ্য, জাপান সফরের তৃতীয় দিনে জাপানি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ৫০ বছরের ঈর্ষণীয় সাফল্যের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সাফল্য আগামী ৫০ বছরের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্ট পাবলিক-প্রাইভেট ইকোনমিক ডায়লগ (পিপিইডি) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে পিপিইডির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পিপিইডির মাধ্যমে জাপানি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের যোগাযোগের একটি ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, প্রতিযোগিতামূলক খরচ, প্রচুর মানবসম্পদ, উচ্চ ক্রয়ক্ষমতা সম্পৃক্ত বিশাল দেশীয় ভোক্তা বাজার এবং ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত লাভজনক অবস্থান হিসেবে দ্রুত আবির্ভূত হচ্ছে।’ সার্বিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে জাপানি ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন এবং দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে।