২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ কর্মী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন এবং রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে প্রায় ৬ লাখ ১৮ হাজার কর্মী গিয়েছেন এবং রেমিট্যান্স এসেছে ২২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে করোনাকালে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার কর্মী গিয়েছেন এবং রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১০ বছরে সবচেয়ে কম কর্মী ২০২০ সালে যাওয়ার পরেও, সে বছর ছিল কর্মী পাঠানোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়। করোনার অতিমারির কারণে হুন্ডিসহ অন্যান্য আনঅথরাইজড চ্যানেলে বিদেশ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে পৃথিবীর সব দেশ থেকেই বৈধ চ্যানেলে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, গত বছর যে আমাদের ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে—হুন্ডিতে টাকা পাঠানো বন্ধ থাকলে এটি হয়তো ৩৫-৩৬ বিলিয়নে দাঁড়াত। তাই হুন্ডিসহ অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো বন্ধ হলে প্রবাসী আয় আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে।
গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ বছর প্রবাসী আয় কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগস্টে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো নিচে নেমেছে। সেপ্টেম্বরেও বৈদেশিক আয় কমার শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় ফরেন রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে। এর প্রধান কারণ হুন্ডি ও অর্থপাচার। একই সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলের সার্ভিস ঘাটতি, বৈধভাবে অর্থ পাঠানোর অতিরিক্ত খরচ এবং ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্যের কারণেই প্রবাসী আয় বাড়ছে না। সর্বশেষ বাজেট প্রস্তাবের সময় আমরা দাবি করেছিলাম, ফরেন রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশে উন্নীত করা এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে কোনো বাড়তি খরচ না নেওয়া। অথচ তা করা হয়নি।
একজন প্রবাসী কর্মী বৈধ চ্যানেলে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠালে, ১০০ টাকা পাঠালে প্রণোদনাসহ ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন। আর প্রবাসী কর্মীদের বৈধ চ্যানেলে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে শতকরা ৩ টাকা বেশি ব্যয় হয়। সেই হিসেবে বৈধভাবে অর্থ পাঠালে শতকরা ৫০ পয়সা কমে যায়। যারা হুন্ডির মাধ্যমে কর্মীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে দেশে পাঠান, তারা শতকরা তিন/ চার টাকা বেশি পান। এ ছাড়া যারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান, তারা কর্মীর কর্মস্থল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দেশে তার পরিবার পরিজনের কাছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ পৌঁছে দেন। এতে কর্মীর কষ্ট করে দূরে গিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে হয় না এবং কর্মঘণ্টাও নষ্ট হয় না। প্রণোদনার চেয়ে হুন্ডির মাধ্যমে খোলাবাজারে দেশে টাকা পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যায়। তাহলে কেন কর্মীরা কষ্ট করে লস দিয়ে বৈধ পথে অর্থ পাঠাবেন? এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আনডকুমেন্টে অনেক কর্মী আছেন, যারা বৈধ কাগজপত্র বা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে নানা রকম ফরমালিটিজ পালন করে দেশে অর্থ পাঠাতে পারেন না। এসব আনডকুমেন্টেড কর্মী অতি সহজে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠান। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর লক্ষ্যে আনডকুমেন্টেড কর্মীদের জন্য সহজ কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া গেলে তারাও হয়তো দেশে বৈধভাবে অর্থ পাঠাতেন।
বিদেশগামী শ্রমিকদের বড় একটা অংশই অদক্ষ। তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে যথাযথ প্রশিক্ষণের মধ্যমে। তাহলে এসব দক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে শ্রমের যথাযথ মূল্য পাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটির অধিক বাংলাদেশি রয়েছেন, যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশ গিয়েছেন। অর্থাত্ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীই অদক্ষ। তাদের তেমন কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। আর কমবেশি ১২ শতাংশ প্রবাসী কোনো না কোনো কারিগরি শিক্ষা, ভাষাজ্ঞান, কম্পিউটারে দক্ষতা অথবা ড্রাইভিং জেনে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশ গিয়েছেন। প্রবাসীদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ডিগ্রিধারীর সংখ্যা খুবই কম হওয়ায় বিদেশে বাংলাদেশিরা ভালো চাকরি পান না। বিদেশে গিয়ে অদক্ষ আধাদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কম বেতনে যেন চাকরি করতে না হয়, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যাওয়া দক্ষ অভিজ্ঞ শ্রমিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি বেতনের চাকরি যাতে পেতে পারেন, তেমনি যোগ্যতা নিয়ে বিদেশে যেতে হবে।
এক্ষেত্রে বায়রাকে অবশ্যই আরো ডাইনামিক ভূমিকা পালন করতে হবে। অধিকসংখ্যক অতি দক্ষকর্মী ও প্রফেশনালস পাঠানোর উদ্যোগে বায়রাকে বড় ক্যাটালিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এটি নিশ্চিত—অদক্ষ কর্মী পাঠালে শুধু কর্মীর সংখ্যাই বাড়বে, প্রবাসী আয় সেই তুলনায় বাড়বে না। কিন্তু কর্মীদের দক্ষ কিংবা অতি দক্ষ করে গড়ে তুলতে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সরকারের তেমন কোনো সহযোগিতা পায় না। তাই সরকারকে জনশক্তি পাঠানোর প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে বেশি করে অতি দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানো যায়, তার ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ইকোনমিক জোনের মতো বিশেষ কোনো অঞ্চলে দক্ষকর্মী তৈরির লক্ষ্যে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনে জমি বরাদ্দ দিতে পারে। স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান, লেবার রিসিভিং কান্ট্রিগুলোতে মার্কেটিংয়ের জন্য বৈধভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর সুযোগ, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে মর্যাদা প্রদানসহ সরকারের নানা উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং আরো বেশি করে দক্ষ অতি দক্ষকর্মীসহ প্রফেশনালস বিদেশে পাঠাতে পারে। তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। সরকারের রিজার্ভের পরিমাণও বাড়বে।
অন্যদিকে প্রতিবছর অর্থ প্রেরণকারী সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করে প্রয়োজনে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা গেলে কর্মীরা বৈধপথে টাকা প্রেরণ করতে উত্সাহিত হবে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী কর্মীদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ ১০/১৫ জন রেমিট্যান্স প্রেরণকারীকে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করা যেতে পারে। সর্বোচ্চ অর্থ প্রেরণকারী এইসব রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে অর্থ পুরস্কার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ ফান্ডে গচ্ছিত অর্থ থেকে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। তাহলে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি আরো বাড়ানো সম্ভব হবে। প্রবাসী আয়ের ধীরগতি কাটিয়ে রিজার্ভ আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রিজার্ভ নিম্নমুখী, ডলারের মূল্য বাড়ছেই। সুতরাং সতর্ক হওয়ার এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। শুধু প্রবাসীদের বেলাতেই নয়, সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পনা ও সুব্যবস্থা।