পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন পাল্লা দিয়ে ভয়ংকর সব মারণাস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে তখনই বিশ্ববাসীর দরজায় কড়া নাড়ছে পারমাণবিক যুদ্ধের উদ্বেগ। কারণ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের উদ্ভাবন ও মজুতের পাশাপাশি বাড়ছে এসব মারণাস্ত্র ব্যবহারের ভয়াবহতা। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি থেকে রাশিয়ার সরে আসার ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিরস্ত্রীকরণের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ।
- নিউ স্টার্ট চুক্তি কী? পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?
ঘটনাটি ২০১০ সালের, চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে ‘দ্য নিউ স্টার্ট’ নামের দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত একটি পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ। মস্কো ও ওয়াশিংটন ঠিক কতগুলো কৌশলগত অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে সংশ্লিষ্ট সে বিষয়গুলো নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যকে আমলে নিয়েই এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তবে ২০১০ সালে স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তিটি কার্যকর হয় ২০১১ সালে। এই চুক্তিতে প্রথমত উভয় দেশ সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ও সর্বাধিক ৭০০টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমারু বিমান মোতায়নের সুযোগ পাবে বলে নির্ধারণ করা হয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ২০২১ সালে চুক্তিটির মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। কেবল চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি দুটি দেশ। উভয় পক্ষ চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য রুশ ও মার্কিন পরিদর্শকদের ওপর দায়িত্বারোপও করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে পরিদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। তবে গত নভেম্বরে মিশরে আলোচনায় বসার কথা থাকলেও সেটি স্থগিত করে রাশিয়া।
রাশিয়া আগে থেকেই এই চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছিল, যদিও চলতি মাসের শুরুতে দেশটি জানিয়েছিল, এই চুক্তিতে তারা থাকতে চায়। তবে রাশিয়ায় পরিদর্শনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল, নিজ ভূখণ্ডে পরিদর্শন করতে দিতে নারাজ রাশিয়া এবং এর মাধ্যমে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে দেশটি।
- নিউ স্টার্ট চুক্তির পতন :
রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে সব আলোচনা-সমালোচনা ধূলিসাৎ করে দিয়ে গেল মঙ্গলবার রাশিয়ার পার্লামেন্টে বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য ন্যাশন’ ভাষণে নিউ স্টার্ট চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেই ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি আজ এই ঘোষণা দিতে বাধ্য হচ্ছি যে, রাশিয়া স্ট্রাযাটিজিক অফেন্সিভ আর্মস ট্রিটিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করছে।
পুতিনের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা। এদিকে পুতিনের পারমাণবিক চুক্তি স্থগিতের বিষয়টি ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। পুতিন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের এই চুক্তিটি বাতিল করায় পূর্ব ইউরোপের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাছাড়া ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তির পতন শুধু দুটি আন্তঃদেশীয় রাজনৈতিক সম্পর্কই অবনতির দিকে ধাবিত করেনি বরং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ভবিষ্যৎকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
সেন্টার ফর ট্র্যাটিজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক হেদার উইলিয়াম বলেন, ‘নিউ স্টার্ট চুক্তির পতনের ফলে আমরা শুধু নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি হারাচ্ছি না, বরং আমরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি যোগাযোগের মাধ্যম হারাচ্ছি। সেই মাধ্যমকে যা এখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আমাদের।
পুতিনের এমন ঘোষণার পরেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, কৌশলগত অস্ত্রের সংখ্যা সীমিত করার বিষয়ে আমরা রাশিয়ার সঙ্গে যে কোনো সময় আলোচনায় বসতে এখনো প্রস্তুত আছি।
ন্যাটোর প্রধান জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মূল চুক্তিগুলো থেকে রাশিয়া হয় সরে গেছে, না হয় লঙ্ঘন করেছে। আর নিউ স্টার্ট চুক্তি নিয়ে তাদের এমন সিদ্ধান্তে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা ধ্বংস করছে রাশিয়া। নিউ স্টার্ট চুক্তি থেকে রাশিয়ার সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা তাদের এই তৎপরতারই একটি প্রমাণ। তবে এ বিষয়ে গেল বুধবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই রেয়াবকভ সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘নিউ স্টার্ট চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেই বিশ্বে পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, আমি এমনটি মনে করি না।
যেহেতু রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের শীর্ষে আছে, তাই ধারণা করা যায়, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে এ দুটি দেশের আচরণ ও সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকেও। এদিকে করোনা মহামারি, ঘনঘন ভূমিকম্প ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো গুরুতর বিভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বর্তমান বিশ্ব। যার ভয়ানক চিত্র ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিশ্ববাসীর। এমতাবস্থায় পারমাণবিক সক্ষমতা ও সংঘাতের ঝুঁকির পাশাপাশি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ নিরসনে একত্রে কাজ করা।