নৌকার বিপরীতে ধানের শীষ নেই, তাই কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের মাঠে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান উত্তেজনা নেই। বরং মাঠের যুদ্ধের চেয়ে স্নায়ুযুদ্ধকে বড় করে দেখছেন স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরা।
এই নির্বাচনে সরকারি দলের মেয়র পদপ্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক (সাক্কু) প্রধান প্রার্থী হলেও মূল আলোচনা সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে (বাহার) ঘিরে। কারণ, আগের দুই নির্বাচনে মনিরুল ছিলেন বাহারের ঘনিষ্ঠ।
এবার বাহারের অনুগত আরফানুল হক আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তাঁকে জেতাতে না পারলে কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহাউদ্দিনের প্রভাব-প্রতিপত্তিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই মেয়র নির্বাচন ঘিরে মনিরুল প্রকারান্তরে বাহারের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক (রিফাত) না জিতলে সরকারি দলের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের দলীয় এবং ব্যক্তি প্রভাব খর্ব হবে। যার রেশ বহুদূর গড়াতে পারে। আর ভোটে দাঁড়ানোর কারণে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র মনিরুল হক হারলে তিনি রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যেতে পারেন।
‘নির্বাচনে রিফাত (আরফানুল) পরাজিত হলে বাহারের (বাহাউদ্দিন) ম্যাজিক ফিকে হয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে দলে তাঁর অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষরা সরব কুমিল্লার রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, ‘নির্বাচনে রিফাত (আরফানুল) পরাজিত হলে বাহারের (বাহাউদ্দিন) ম্যাজিক ফিকে হয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে দলে তাঁর অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষরা সরব হবে, যা তাঁর নিজের নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর সাক্কু (মনিরুল) পরাজিত হলে তাঁকে সরকারি দলের ধকল সইতে হবে।
নিজ দলে ফেরার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে যাবে।’ অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের দাবি, বিএনপি তাঁর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিলেও তিনি দলের বাইরে যাননি। তিনি বলেন, ‘আমি বিএনপিতে আছি, থাকব। যদি তারা মনে করে সাক্কুকে দরকার, তাহলে আমি তো আছি। আর দরকার মনে না করলে আমি আমার মতো বিএনপি করুম।’
কুমিল্লার রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের। তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক তাঁর পছন্দেই মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।
যে কারণে অতীতে মনিরুল হকের মতো এবার আরফানুল নির্বাচিত হলে তিনিও বাহাউদ্দিনের ‘ছায়া মেয়র’ হিসেবে থাকবেন বলে এলাকার রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন ।
অবশ্য আরফানুল হক বলেন, ‘ছায়া মেয়র কথাটির নিন্দা জানাই। নির্বাচিত হলে আমি আমার প্রজ্ঞা ও বিচার–বুদ্ধি অনুযায়ী সিটি করপোরেশন চালাব। তিনি (বাহাউদ্দিন) আমাকে তৈরি করেছেন, আমি তাঁর কর্মী। তাঁর নির্দেশ মেনে কাজ করব।’
দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লায় ব্যাপক প্রচার আছে যে বাহাউদ্দিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েই বিএনপির কেন্দ্রীয় ও কুমিল্লার দায়িত্বশীল নেতা মনিরুল হক এর আগে দুবার মেয়র হয়ে সিটি করপোরেশন চালিয়েছেন। ওই দুই নির্বাচনেই মনিরুলের জয়ের নেপথ্যে বাহাউদ্দিনের নীরব ভূমিকা ছিল বলে নিজ দলেই তাঁর সমালোচনা ছিল। ওই দুই নির্বাচনে বাহাউদ্দিনকে নিজ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ততটা সক্রিয় দেখা যায়নি।
এর মধ্যে ২০১২ সালে মনিরুলের প্রথম মেয়র নির্বাচনে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের আফজল খান, আর ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা। এই পরিবারের সঙ্গে বাহাউদ্দিনের রাজনৈতিক বৈরিতা পুরোনো। এবারও আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা, ছেলে মাসুদ পারভেজ খানসহ ১৪ জন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাহাউদ্দিনের অনুগত আরফানুল হকই মনোনয়ন পান।
স্থানীয়ভাবে প্রচার আছে, বাহাউদ্দিনের ধারণা ছিল, মনিরুল হককে বললে তিনি প্রার্থী হবেন না। মনোনয়ন নেওয়ার আগে দলকেও এমন বার্তা দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে মনিরুল হক বলেন, ‘ওনার (বাহাউদ্দিন) কথায় তো আমি সরে যেতে পারি না। নিজের দলের কথাই শুনি নাই জনগণের লগে থাকনের লাইগ্যা। ওনার কথা শোনার তো প্রশ্নই আসে না।’
বরং নির্বাচনের ব্যাপারে মনিরুল এতটাই উৎসাহী যে এ সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তও তিনি মানেননি। যার ফলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিএনপি তাঁকে দলের সব পদ-পদবি থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে নিজ দল বিএনপির সঙ্গে মনিরুল হকের একগুঁয়েমি অবস্থান, অন্যদিকে আরফানুল হককে প্রার্থী করাতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাহাউদ্দিনের অনড় অবস্থান নিজ নিজ দলে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
ফলে এ থেকে বের হতে দুজনই মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। যে বাহাউদ্দিনকে কুমিল্লার গত দুটি মেয়র নির্বাচনে সেভাবে সক্রিয় দেখা যায়নি, সেই তিনিই এখন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ উপেক্ষা করে নির্বাচনী এলাকায় থাকছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অভিভাবক, শ্রমিক সংগঠন ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিপক্ষরা; যার সত্যতা পেয়ে বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়তে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এই নির্বাচন আরফানুল বনাম মনিরুল নয়, বরং বাহাউদ্দিন বনাম মনিরুল হিসেবে বেশি আলোচিত হচ্ছে।
অবশ্য এ কথায় ঘোরতর আপত্তি রয়েছে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন বাহার বনাম সাক্কুর লড়াই—এমন কথা প্রথম শুনলাম। কেন? কী কারণে তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা হবে?’
এদিকে এখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ নির্বাচনে আরফানুল হক জিতলে তা হবে বাহাউদ্দিনের জয় হিসেবে বেশি আলোচিত। এতে স্থানীয় রাজনীতিতে বাহাউদ্দিনের প্রভাব ও কর্তৃত্ব আরও একচ্ছত্র হয়ে উঠবে।
অপরদিকে মনিরুল হক জিতুক বা হারুক, সরকারি দল থেকে তাঁর ওপর একটা ঝড় বয়ে যেতে পারে। কারণ, আরফানুল হক নির্বাচনী অঙ্গীকারেই ঘোষণা দিয়েছেন, সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
আবার সবকিছু মোকাবিলা করে মনিরুল হক জিতলে তা হয়তো বিএনপিকে বিব্রত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। এ ছাড়া মনিরুল হক জিতলেও সিটি করপোরেশনে তিনি স্বস্তিতে থাকতে পারবেন কি না, এ নিয়েও নির্বাচনী মাঠে নানা আলোচনা আছে।
অবশ্য মনিরুল হক বলেন, ‘আমি যদি আমার মতো করে সিটি করপোরেশন চালাতে পারি চালামু। যদি না পারি ছাইড়া দিমু।’
১৩ জনকে নিয়ে ঢাকায় বৈঠক
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে যে ১৪ জন মনোনয়ন চেয়েছিলেন, আরফানুলকে প্রার্থী ঘোষণার পর অপর ১৩ জনকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে দেখা যাচ্ছে না। গতকাল শুক্রবার এই ১৩ জনকে নিয়ে ঢাকায় বৈঠক করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। তাঁদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে বলা হয়।
কিন্তু এ নির্দেশনা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া কেউ কেউ। বৈঠক শেষে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নুর উর রহমান মাহমুদ (তানিম) বলেন, তিনি বৈঠকে বলেছেন যে সংসদ সদস্য (বাহাউদ্দিন) এ নির্বাচনকে ব্যক্তিগত জয়-পরাজয় হিসেবে দেখছেন। সংগঠনের জয়–পরাজয় তাঁর কাছে গৌণ।