রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে নতুন সরকার গঠিত হলে প্রয়োজনে পদ ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আমি চাই সম্প্রীতি, রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য ও সুন্দর নির্বাচন। আমাদের দিয়ে না হলে যে কাউকে দিয়ে করানোর (নির্বাচন) জন্য যদি আমাকে এই পদ ছেড়ে যেতে হয়, আমাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে না। রিকোয়েস্ট করার আগেই চলে যেতে পারব।
গতকাল রবিবার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রথম দিনে সিইসি আরো বলেন, ‘এই পদে কিন্তু আমরা আমোদ-ফুর্তি করতে আসিনি। কঠিন একটি দায়িত্ব নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে এসেছি। কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। ’ গতকাল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ কংগ্রেস ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)—এ চারটি দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এদের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ মুসলিম লীগ উপস্থিত হয়নি। অন্য তিনটি দলের সঙ্গে সংলাপে কমপক্ষে ছয় দফায় বক্তব্য দেন সিইসি।
সকালে এন?ডিএমের সঙ্গে সংলাপের শুরুতেই রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, সব দল সহযোগিতা না করলে ইসি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ’
সিইসির ওই বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘কেউ একজন পিস্তল নিয়ে মাঠে নামলেই আমি শটগান নিয়ে মাঠে নামতে পারি না। কারণ আইন আমাকে বাধা দেয়। ভোটকেন্দ্র দখল হলে প্রশাসনকে দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। প্রশাসনের নিরপেক্ষ আচরণের নিশ্চয়তা ইসিকে দিতে হবে। ’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ‘তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল বা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানো’ বক্তব্যে বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে—এ ধরনের বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার শামিল।
পরে বিকেলে আগের বক্তব্য থেকে সরে আসেন সিইসি। বাংলাদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে সংলাপে তিনি বলেন, ‘যদিও নির্বাচন এক ধরনের যুদ্ধ; অনেকেই বলছেন, আসেন যুদ্ধের মাঠে আসেন। সেখানে এলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে না, আপনাদের জনসমর্থন নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আপনারা তলোয়ার, রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করবেন না। এই যুদ্ধে নামতে হবে জনসমর্থন নিয়ে। ভোটকেন্দ্র দখল হলে প্রতিরোধ করবেন, নালিশ করবেন। ইসি আপনাদের সঙ্গে থাকবে। ’
সিইসি বলেন, ‘ইসি সহিংসতা বন্ধ করতে পারবে না। দলগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ খেলোয়াড় কিন্তু আপনারা। আপনারা মাঠে খেলবেন, আমরা রেফারি। আমাদের অনেক ক্ষমতা আছে। সে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে। এখন পর্যন্ত আমরা শতভাগ স্বচ্ছ আছি। ভবিষ্যতে চোর হব, না ডাকাত হব—এখনই সেটা বলা ঠিক হবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচন বা ২০১৮ সালের নির্বাচনের দায় আমাদের ওপর চাপাবেন না। ’
সিইসি আরো বলেন, দেশে একটিমাত্র দলের ৩০০টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই। তবে ইতিহাস বলে, সে ক্ষেত্রে অচিরেই গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবে। স্বৈরতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণতন্ত্রের আরাধ্য পুনরুদ্ধার হয়ে পড়বে দুরূহ।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, রাজনৈতিক দল আর সরকার এক নয়। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, তখন তিনি সরকারপ্রধান, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নন। এটি বুঝতে হবে। আমরা সরকারের সাহায্য চাইব। সরকার যদি সহায়তা না করে, তাহলে নির্বাচনের পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে। ’ তিনি বলেন, ‘প্রধান দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়া খুবই প্রয়োজন। কোনো দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে অবশ্যই বাধ্য করতে পারব না। তবে সব দলকে কার্যকরভাবে অংশ নিতে বারবার আহ্বান করে যাব। সে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। ’
ইভিএম প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে অপপ্রচার সমানে চলছে। এ সম্পর্কে বিভ্রান্তি-সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন হচ্ছি। কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনিয়ম, সহিংসতা, ব্যালট পেপার ছিনতাই হলে প্রতিরোধ কতটা সম্ভব হবে? আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় নেতারা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতা ও মতৈক্যের মাধ্যমে বিতর্কিত বিষয়গুলোর নিরসন করে আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য অনকূল পরিবেশ ও সমতল ভিত্তি সৃষ্টি করবেন। এ ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা সংগঠিত হয়ে এগিয়ে এসে জাতির একটি সংকটময় মুহূর্তে তাঁদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞান প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সংলাপে আহ্বান করে আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন। ’
এনডিএমের ১৩টি প্রস্তাব
সংলাপে এনডিএম ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে। এর মধ্যে আছে নির্বাচনের সময় সিইসি ‘সুপার প্রাইম মিনিস্টার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন; জনপ্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসির হাতে; ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়ার পদ্ধতি বাতিল করতে হবে; একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ করতে হবে; ইভিএমে পেপার ট্রেইল যুক্ত করতে হবে; ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপন করতে হবে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে। সংলাপে বিএনএফের পক্ষ থেকে তেমন সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব ছিল না। দলটির নেতারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অঙ্গীকার জানিয়ে বলেন, ইসিকে তাঁরা সর্বাত্মক সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছেন। অন্যদিকে জাতীয় বাজেটে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা, ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা, ইভিএমে পেপার ট্রেইল যুক্ত করা, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলির ক্ষমতা ইসির হাতে আনাসহ ১৬ দফা প্রস্তাব রাখে বাংলাদেশ কংগ্রেস।
সিইসির সভাপতিত্বে সংলাপে চার নির্বাচন কমিশনারসহ ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আজ ৪ দলের সঙ্গে সংলাপ
আজ সোমবারের সংলাপে আমন্ত্রিত চারটি দল হচ্ছে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট, খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।