জগতে ফ্রি বলতে কিছু নেই। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, ‘দেয়ার ইজ নো সাচ থিংস অ্যাজ আ ফ্রি লাঞ্চ’। ফ্রি পাওয়া মানে আরেক জনের ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করা। বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছু অর্জন সব সময়ই একটা প্রশ্নের জন্ম দেবে। ফ্রি কোনো কিছু গ্রহণ করলে তার বিনিময়ে আপনাকে কিছু দিতে হবে। সেটা বস্তুগত কিংবা অবস্তুগত হতে পারে। ফ্রি একটা লোভ! এই লোভকে কিছু মানুষ নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কাজে লাগায়। ফ্রি কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে নিজেকে জিগ্যেস করতে হবে বিনিময়ে কী দিতে হবে?
ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের মানুষকে ফ্রি চা পানের সুযোগ দিয়েছিল। মানুষ শুরুর দিকে সন্দেহ করে চা পান করতে অনাগ্রহী ছিল। চা কোম্পানিগুলো চায়ের উপকারিতা বর্ণনা করে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। রেল স্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল, হাটবাজারে ফ্রি চা পানের হিড়িক পড়েছিল। ১০০ বছর পর এখন মানুষ নিজের টাকা খরচ করে ফ্রি চা পানের মর্ম বুঝতে পারে। চা পান এখন দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।
ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে ধূমপায়ী করার ক্ষেত্রে বিড়ি-সিগারেট কোম্পানিগুলো বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। কোম্পানিগুলো শহর-বন্দর, হাটবাজারে ফ্রি বিড়ি-সিগারেট বিতরণ করে জনসাধারণকে ধূমপানে উত্সাহিত করত। বিড়ি কোম্পানিগুলো গ্রামের হাটবাজারে গানবাজনা, পুতুলনাচ, জাদু, সার্কাস দেখিয়ে মানুষ জড় করে বিড়ির উপকারিতা বর্ণনা করত। সিগারেট কোম্পানিগুলো বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে সিগারেটের প্রচারণা চালাত। শহরবন্দরে বড় বড় বিলবোর্ডে জনপ্রিয় নায়কের মুখে সিগারেট দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। পত্রিকার পাতা জুড়ে সিগারেটের বিজ্ঞাপন থাকত। সিনেমা নাটকে নায়কের মুখে সিগারেট দিয়ে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা হতো। শুরুর দিকে সিগারেট কোম্পানিগুলো ফ্রি সিগারেট বিতরণ করে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়েছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের গরিব চাষিদের তামাক চাষে বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছে। বিড়ি সিগারেট আসার আগে আমাদের দেশের মানুষ হুক্কা দিয়ে ধূমপান করত। আবার কেউ কেউ তামাক পাতাকে আগুনে সেঁকে পাতায় মুড়িয়ে বিড়ি বানিয়ে খেত। এসব প্রস্তুত করতে সময় লাগত বলে নেশা উঠলে যখন-তখন দেশলাই জ্বালিয়ে ধূমপানের সুযোগ পেত না। ব্যবসায়ীরা মানুষের কাছে ধূমপানকে সহজলভ্য করার জন্য কাগজে বিড়ি-সিগারেট বানিয়ে প্যাকেট করে দিয়েছে, যাতে ইচ্ছে করলে দেশলাই জ্বালিয়ে ধূমপান করতে পারে। এসব বিড়ি-সিগারেটের প্যাকেট সহজলভ্য বলে অনেকই মজুত করতে পারে।
ক্ষমতাবান মানুষের বাসাবাড়িতে মিষ্টি-দই, ফলমূল, কাপড়চোপড়, মাছ নিয়ে যারা হাজির হন তাদের মনের মধ্যে একটা ইচ্ছে থাকে। কখনো বদলি, প্রমোশন, চাকরি, শাস্তি মওকুফ, সুপারিশ, পদ লাভের আশায় ক্ষমতাবানদের বাসাবাড়িতে আনাগোনা করতে দেখা যায়। কাউকে সমীহ করা, সালাম দেওয়া, প্রশংসা করার মধ্যেও ব্যক্তির স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।
বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবার টেবিলে যে পরিমাণ অস্থিরতা দেখা যায় তা থেকে অনেক কিছু বুঝার আছে। গুরুত্বপূর্ণ লোককে দেখেছি গাড়ির ড্রাইভারের জন্য খাবারের প্যাকেট চেয়ে নিতে। তারা ইচ্ছে করলে ২০০-৫০০ টাকা ড্রাইভারের জন্য দিতে পারেন। ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজকরা সবাই মিলে টাকাপয়সা জোগাড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেখানে হয়তো ড্রাইভারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা রাখা যায়নি। সেটা নিয়ে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করেন। একবার কমদামে মুরগির ডিম দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। প্রতি ডজন বাজারমূল্যের চেয়ে ৩০-৪০ টাকা কমে। সেটা নিয়ে ঢাকা শহরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। মানুষের দীর্ঘ লাইন, হুড়াহুড়ি, মারামারি টেলিভিশন ও পত্রিকার মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ দেখতে পেয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠি চার্জ করতে হয়েছিল। আয়োজকরা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বিক্রি বন্ধ করে চলে যায়।
গ্রামে একটা প্রবাদ আছে, বাঙালি আলকাতরা ফ্রি পেলে শার্ট পেতে নেয়। ব্যবসায়ীরা মানুষের এই ফ্রি পাওয়ার মানসিকতা খুব ভালো করে বুঝতে পারে। তারা পণ্য বিক্রি বাড়ানোর জন্য নানান রকমের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি, এক কেজি কিনলে ১০০ গ্রাম ফ্রি, চিনি কিনলে সেমাই ফ্রি, চিংড়ি কিনলে লাউ ফ্রি, বিস্কুটে ৩০ শতাংশ ফ্রি, চাল কিনলে ডাল ফ্রি ইত্যাদি অফার আমাদের চোখের সামনে পড়ে। প্রয়োজন থাকুক কিংবা না থাকুক অমনি কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে কেনার জন্য।
একশ্রেণির মানুষ সবকিছু ফ্রি পাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তারা সরকারি সেবাসমূহ ফ্রিতে আশা করে। চিকিৎসা, ওষুধ, পরিবহন, সেবাসহ সব খাতে ছাড় পাওয়ার জন্য আগ্রহী লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব দাবি দিনদিন জোরদার হচ্ছে। প্রবীণদের একটা বড় অংশ চিকিৎসা, সেবা, ওষুধ ফ্রিতে, পেনশন-ভাতা বৃদ্ধি, সব যানবাহনে বিশেষ ছাড়ে চলাচলের সুযোগ-সুবিধা চায়। তাদের অনেকই পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবীণদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার উদাহরণ দেন। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের দেশগুলো প্রবীণদের কী কী সুবিধা দেয় সেসব কথা আমাদের পণ্ডিত ব্যক্তিদের মুখে প্রায়ই শুনতে পাই। বাংলাদেশে এসব সুযোগ-সুবিধা নেই বলে আক্ষেপ অনুশোচনার অন্ত নেই। পশ্চিমা বিশ্বের প্রবীণরা সরকার থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ফ্রি পান না। তারা যখন যৌবনে ছিলেন তখন সরকারকে আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ ট্যাক্স হিসেবে প্রদান করেছিলেন। বার্ধক্যে এসে তারা সরকারের কাছ থেকে ফেরত পাচ্ছেন। বাংলাদেশে মাত্র ২৮ লাখ মানুষ রিটার্ন জমা দেন। এরমধ্যে একটি অংশ সর্বনিম্ন করদাতা হিসেবে রিটার্ন জমা দেন। আমাদের দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে জর্দার কোম্পানির মালিক সর্বোচ্চ করদাতা, সেখানে রাষ্ট্রীয় সব সেবা নাগরিকদের ফ্রি করা অনেক কঠিন কাজ।
দুর্দশাগ্রস্ত অসহায় নারী-পুরুষ যারা শ্রম বিক্রি করে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। একদল মানুষ আছেন তারা কর্মজীবনে নানান রকমের সুযোগ- সুবিধা নিয়েছেন। এখন বার্ধক্যে এসেও নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য দেনদরবার করছেন। কর্মজীবনে যারা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নীরব থেকেছেন বেশি, তারাই এখন ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বানানোর জন্য যাদের ওপর জনগণ দায়িত্ব দিয়েছিল, তারা নিজেদের কল্যাণের ব্যাপারে অধিক মনোযোগী ছিলেন।
বাংলাদেশকে যেসব দেশ অর্থ সাহায্য দেয়, সেখানে অন্তর্নিহিত স্বার্থ বিরাজমান থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা যখন দান করি, তখন আমাদের বালা-মুসিবত, বিপদাপদ দূর করতে স্রষ্টার আনুকূল্য লাভের আশায় থাকি। মানুষ ভালো বলবে, প্রশংসা করবে এটুকু শোনার জন্য কেউ কেউ দান করে থাকেন। দান করলে পরকালে পুরস্কার পাবেন—এই আশা এবং বিশ্বাস অধিকাংশ মানুষের। সব ফ্রি জিনিসের পেছনে একটা স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। যিনি ফ্রি গ্রহণ করবেন তিনি প্রকারান্তরে ফ্রি দাতার স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকেন। যিনি কোনো কারণে ফ্রি কিছু গ্রহণ করেছেন, তিনি সচেতনভাবেই সমপরিমাণ বা ততোধিক ফেরত দিয়ে নিজের কাছে দায়মুক্ত থাকতে হবে। পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু পাওয়া সম্মানের। বিনা পরিশ্রমে কিছু পাওয়া অসম্মানজনক। ফ্রি পাওয়ার মানসিকতা আমাদের আত্মমর্যাদা তৈরির পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে আছে।