মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের উষালগ্নে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকসহ দেশের আলোকবর্তিকাসম প্রজ্ঞাবানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। দেশ ও জাতিকে মেধাশূন্য করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যজগতে খরা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। এই বন্ধ্যা সময়ে মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসেন। একুশ উদযাপনের ক্ষণে বাংলা একাডেমির বটতলায় মাদুর বিছিয়ে তার প্রকাশনীর কতিপয় বই নিয়ে একজন নিঃসঙ্গ শেরপার মতো অনিশ্চিত যাত্রায় পা রাখেন। অনেক টিপ্পনী আর শ্লেষমাখা উক্তিকে উপেক্ষা করে চিত্তরঞ্জন সাহা তার পথচলা অব্যাহত রাখেন। কী ছিল বিধাতার মনে! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেশবরেণ্য অনেক প্রকাশনী তার দেখানো পথে বাংলা একাডেমিতে বইয়ের স্টল খোলার মাধ্যমে বইমেলার স্বপ্ন বপন করেন। অনিশ্চয়তায় দোলায় দুলে সেই বইমেলা পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে আজ বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে।
আবহমান বাংলায় আমরা নানারকম মেলা দেখি। অধুনাকালেও রপ্তানি মেলা, পিঠা মেলাসহ বিভিন্ন মেলা দেখে থাকি। এসব মেলাকে নানাবর্ণে উপস্থাপিত করলেও এর উদ্দেশ্য মূলত বাণিজ্যিক। এসব মেলার সঙ্গে বইমেলার মৌলিক পার্থক্য আছে। বইমেলা মহান একুশের পাদপীঠে সৃষ্ট। তাই রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ জানা-অজানা ভাষাশহিদের আত্মদান এবং তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাওয়ার লড়াই-ই বইমেলার চেতনার মূল বিষয়। তাই বইমেলা নিছক মেলাই নয়, বরং সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতা, ধর্মীয় পশ্চাত্পদতা, ভাষার বিকৃতির বিরুদ্ধে একটি আন্দোলনের নাম।
বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশ বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। স্মার্টফোনে আটকে থেকে নির্বোধ আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। পাঠ্যসূচির বাইরে সাহিত্যের যে বিশাল সম্ভার তরুণ প্রজন্ম সেই সম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্রও বেশ আশাব্যঞ্জক। প্রতি বছর মেলায় প্রায় পাঁচ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। এত বিপুলসংখ্যক বই প্রকাশ নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও এই কথাও সত্য যে, বইমেলা বিনোদনের নিত্যনতুন ফ্যাশনের প্রদর্শনী নয়, বরং জ্ঞান ও মেধার চর্চাই বটে। আজকে যারা লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক—তারাও একসময় অপরিচিত ছিলেন। সময়ের ট্রেন্ড ঠিকই সম্ভাবনাময় সেই নবীনদের প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং রাতারাতি তারকাখ্যাতি পাওয়ার প্রলোভনে উন্মত্তদের হারিয়ে ফেলেছে।
প্রায় ৫ হাজার বইয়ের লেখনীর গুণমান সামগ্রিকভাবে কেমন, সেটি বলা মুশকিল। কেননা এত বিশালসংখ্যক বই কারো-বা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পঠন প্রায় অসম্ভব এক কর্মযজ্ঞ। তবে দৈবচয়নের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, যেমন—কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, গবেষণা, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি শাখায় বইয়ের উৎকর্ষের পরিমাপ অনেকখানিই সম্ভব। তবে এক জন পাঠক হিসেবে দৈবচয়নের ওপর ভিত্তি করে বইমেলার এক সারি থেকে অন্যূন ১০টি স্টলের বই ভালো করে দেখলে দেখা যাবে অনেক বই-ই দলকানা, জন্মান্ধদের হাতে রচিত। এসব বই লেখার উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও বইয়ের কোনো সীমানা বা পরিধি নেই, তবুও যুগে যুগে প্রায় সব ভাষায় অনেক অপবই প্রকাশিত হয়েছে। তবে আপাতভাবে স্ফুলিঙ্গের মতো কিছুটা জ্বলে উঠলেও সেগুলো শেষতক উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেছে।
বইমেলায় প্রতিদিন যত মানুষ আসে, তারা সবাই অন্তত একটি করে বই কিনলে বইমেলায় পরিবেশিত সব বই-ই দুই-এক দিনের ভিতরেই শেষ হয়ে যেত। বিনোদনের প্রায় উপচারবিহীন এই রাজধানীতে বইমেলা অনেকের কাছে কখনো কখনো ট্যুরিস্ট স্পট। তাই দেখা যায়, দূরদূরান্ত থেকে যাতায়াতের জন্য বড়মাপের টাকা খরচ করে, মেলায় ঘোরাঘুরি শেষে চর্ব্যচূষ্যলেহ্যপেয় দিয়ে রসনাবিলাসে বাজেটের প্রায় সব পয়সা শেষ করে সেলফির আনন্দে ভেসে বই না কিনে খালি হাতে ফিরছেন।
হুমায়ূন আহমেদ একাই বইমেলার আদল অনেকটি বদলে দিয়েছিলেন। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রন্থপ্রেমীরা তার অটোগ্রাফযুক্ত বই কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে। হুমায়ূনের প্রয়াণের দীর্ঘসময় পেরিয়ে গেলেও বাংলা সাহিত্যের যে কোনো শাখা আজও তার মতো পাঠক আদৃত সাহিত্যিকের জন্ম দিতে পারেনি।
বিগত দুই বছর করোনার কারণে বইমেলা প্রকারান্তরে বন্ধ ছিল। তাই এ বছর বইয়ের সংখ্যা সংগত কারণে বেড়ে যায়। ফলে কাগজ, বাঁধাইসামগ্রীসহ বই প্রকাশের বিভিন্ন উপাদানের দাম বেশ বেড়ে যায়। ফলে বইয়ের দাম গতবারের চেয়ে যথেষ্টই বেশি। যারা বইমেলার জন্য একটি বাজেট তৈরি করেন এই দুর্মূল্যের বাজারে, সেটিকে যথেষ্ট কাটছাঁট করতে হয়েছে। ফলে সেই বাজেটে বই কিনতে গিয়ে দেখা গেল ক্রীত বইয়ের সংখ্যা যথেষ্টই কমে গেছে। সারা পৃথিবীতে সৃজনশীল বইয়ের পেপার ব্যাকের ব্যাপক চল আছে। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশক পেঙ্গুইন প্রকাশনী অল্প বাজেটের পাঠকের জন্য পেপার ব্যাক ভার্শনও বাজারে ছাড়ে। এই বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাবা যায় কি না সেটিকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
মেলায় নর-নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধসহ ব্যাপক লোক সমাগম হয়। তাদের নিরাপত্তা আপাতদৃষ্টিতে ভালোই বলে মনে হচ্ছে। এখন বইমেলা ২০২৩-এর পর্দা পড়বার কাউন্টডাউন চলছে। এই বছর বইমেলার মধুরেণসমাপয়েৎ হোক সেটিই বাংলাভাষীদের প্রত্যাশা।